“ তোমাকে ঋতু আঙ্কল বলে ডাকব না ঋতু আন্টি ? ’’ , তিনতলা বাড়ির অলিন্দে তারকার ছোট্ট পুত্রসন্তানটি প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছিল ওঁর দিকে । প্রথমবার নয় , এমন অনেক প্রশ্নই প্রতিমুহূর্তে ওঁর দিকে ধেয়ে আসে । আগে ঘাবড়ে যেত ও , লজ্জায় , অভিমানে বুকের ভেতরটা একেবারে ফাঁকা হয়ে যেত , হঠাৎই ছোটবেলা থেকে চেনা সমাজটা মুহূর্তে অচেনা হয়ে যেত , ঘেন্না করত । এখন আর হয়না । আসলে ও জানে এই শহরটা ওকে যেমন মেনে নিতে পারবে না , তেমনি হাজার চেষ্টাতেও অস্বীকার করতে পারবে না ওকে ।
“ বোরোলীন – বঙ্গ জীবনের অঙ্গ ’’ এই ক্যাচলাইনটা আশির দশকের বাঙালির মনে দাগ কেটেছিল ঠিকই কিন্তু তখনও এর পেছনের সৃষ্টিশীল বৃক্ষটির ছায়া পায়নি আম জনতা । সালটা ১৯৯২ বাংলা তথা ভারতের চলচিত্র জগতের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্কটি সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন । ঐ বছরই সত্যজিতের একনিষ্ঠ ভক্ত এই লোকটি একটি হীরের আংটি বানালেন খুব যত্ন করে । কিন্তু কেউ হলে এলো না । প্রথম ছবি কাউকে দেখাতে না পারার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে দিন কাটতে থাকল । অনেক ছবির কল্পনা ভেতরে ভেতরে পরিপুষ্ট হতে থাকল কিন্তু ব্যর্থতার ভয়ে বেরনোর সাহস করল না কেউ । টানা দুবছর পর বাঙালির সামনে এলো উনিশে এপ্রিল । হল ভরল , হাততালি পড়ল , জাতীয় পুরস্কার এলো আর সামান্য থেকে মহান হওয়ার একটা প্রক্রিয়ার শুভ সূচনা হল । তারপর আরেকটা ব্রেক । ১৯৯৭ সালে এলো দহন , বাঙালি দেখল আক্রান্তের লজ্জা , ভয় আর পিছিয়ে আসার জ্বলন্ত কাহিনী । তারপর তো বাড়িওয়ালী , তিতলি , অসুখ দাগ ফেলে গেছে আমজনতা থেকে আঁতেল ক্রিটিক সবার মনে । আগাথা ক্রিস্টির মিস মার্পলের পরদায় যে ওরকম শুভ মহরত হবে , তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কেউ । হল থেকে বেরনো প্রতিটা অবাক চোখে ওঁর সাফল্য লুকিয়ে ছিল । চোখের বালি মুছে নিয়ে প্রচণ্ড বৃষ্টি থেকে ঘরে ফিরে রেইনকোটটা খুলতে খুলতেই ঋতুপর্ণ ঘোষ নামটা বাঙালির অন্তরমহলে ঢুকে গেছে । আর তখন থেকেই দোসর হয়েছে ‘ ও কি হিজড়ে ? ’ , ‘ ওঁর কবার সেক্স চেঞ্জ অপারেশন হয়েছে ? ’ এমন অনেক প্রশ্ন । ঋতুর কথায় , বাঙালি যাকে সত্যজিৎ রায়ের উত্তরসূরির আসন দিয়ে দিয়েছে তার লিঙ্গ নিয়ে এমন দ্বন্দ্ব হজম করতে পারেনি । যে আমাদের আইকন তার ম্যাস্কুলানিটি নেই , এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি সমাজ । কিন্তু শিল্পের কাছে মাথা ঝোঁকাতে হয়েছে রদ্দি সমাজকে । ঋতুকে সমাজ অস্বীকার করতে পারেনি । ঋতুর বলিউড যোগ শুরু The Last Lear দিয়ে । তারপর থেকে ভারতীয় ছবির খেলার মাঠে ওঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আজ অব্দি তৈরি হয়নি । ঋতুর জীবনের পরবর্তী অধ্যায়টা যেকোনো ছবির চিত্রনাট্যকে হার মানাবে । কৌশিক গাঙ্গুলির আর একটি প্রেমের গল্পের জন্য ঋতু নিজের শরীরটাকে নারীসুলভ করে তুলতে চাইলেন । ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট হল আর হল জীবন সঙ্কটে রেখে অ্যাবডমিনাল হরমোনাল অপারেশন । এবার ছিল অভিনেত্রী ঋতুকে চিনে নেওয়ার পালা । জীবনের শেষ দিকটায় ঋতুপর্ণ LGBT Communityকে নিয়ে সিনেমার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন । সেক্স ওরিয়েন্টেড অপারেশনের পর অনেক বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয় ঋতুর । তবু ঋতু থামেনি । ঋতু আসলে সেই সব তথাকথিত মেয়েলি স্বভাবের ছেলেদের প্রতিনিধি , তাদের আইকন । ঋতু যা চাইত , তাই করত । ওখানেই ওঁর নিজস্বতা , ওখানেই ওঁর স্বকিয়তা ।
ঋতুর মত সম্পর্কের গল্প পৃথিবীর খুব কম পরিচালকই বলতে পারে । সব চরিত্র কাল্পনিক , আবহমান , নৌকাডুবি এই সবগুলিই এক একটা মাস্টারপিস । সম্পর্কের এমন অপরূপ বাঁধন বাঙালি আগে কখনও দেখেনি । ঋতুপর্ণর চলচিত্রের আর একটা বৈশিষ্ট হল চেম্বার ড্রামা । ঐ একটা ঘরের মধ্যে দুজন লোকের একান্ত কথাবার্তা চলছে আর হাজার হাজার দর্শক চেয়ার আঁকড়ে সেটা দেখছে । কজনের আছে এই ঐশ্বরিক ক্ষমতা !
Memories in March এর পর শেষবার ঋতুকে বড়পর্দায় দেখা যায় চিত্রাঙ্গদায় । ততদিনে ঋতুর শরীর ভাঙতে শুরু করেছে । ঐ কঠিন সার্জারিগুলো শরীর নিতে পারেনি । তবুও শুটিং চলছিল , রোববার প্রতিদিনে কলম চলছিল । তারপর সবাইকে ফাঁকি দিয়ে একদিন কোথায় যে চলে গেল ঋতু । কোন সত্যান্বেষী খুঁজে পেলনা তাঁকে । ২০১৩ এর ৩০শে মে দুপুরে নন্দনের কাচের বাক্সের ভেতরে থাকা ঋতুর চোখে চেনা কালো Sunglass এর বদলে ছিল দুটো সবুজ তুলসীপাতা । ঠোঁটে লেগে থাকা ঐ হাসিটাও হয়তো ছিলনা । আমার মনে নেই । আমার শুধু মনে আছে পরিচালক ঋতুকে যে বাংলাকে ডজনখানেক জাতীয় পুরস্কার , গোল্ডেন লেপার্ড , গোল্ডেন হুগো এনে দিয়েছে । নারীদের নতুন করে চিনতে শিখিয়েছে দহন বা তিতলিতে । পাহারের ধারে কেডস্ পড়ে উদ্দাম নেচে বেড়ানো পোয়েনজিৎকে প্রসেঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় করে তুলেছে যে ঋতুপর্ণ , তাঁকে আমি আমৃত্যু মনে রাখব । আমি শিল্পীর ব্যাক্তিগত দিকগুলোকে মনে রাখব না । শিল্পীর মস্তিষ্ক আমার ভাববার বিষয় , ওঁর কোমরের নীচের অঙ্গটা নয় । শিল্পীর কোন লিঙ্গ হয়না । ও নারীও নয় , পুরুষও নয় , ও ঋতুপর্ণ ।