দিনের আলো ফুরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। রক্তিম আলোয় সেজে উঠেছে ঢাকুরিয়া লেক। আমি আর অনু বসে আছি বেঞ্চিতে। আমি বসতে চাইনি যদিও, রীতিমতো জোর করেই বসিয়ে রাখা হয়েছে আমাকে। অনুর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মেঘ আর মেঘের পেছনে রাই। কারোর মুখ দিয়েই কোনো কথা পড়ছে না।
“মেঘ কিন্ত রাইকে সত্যিই খুব ভালোবাসে”, শুরুটা অনুই করলো।
আমি একবার মেঘের দিকে তাকালাম, তারপর একবার রাইয়ের দিকে তাকালাম। দু’জনেই দেখি মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
তারপর অনুকে একটু টিস করেই বললাম,
– তাহলে আর কি, এবার থেকে তিনজনে মিলে শুরু করে দে। রাইকে আমার আর কিছু বলার নেই। তোরা যখন নিজেদের মধ্যে সবকিছু ঠিক করেই নিয়েছিস, তখন আমি বলার কে হই!
– কিন্তু…
– কোনো কিন্তু নয়। রাইয়ের বাড়িতে কিছু না জানালেই তো হল? জানাবো না। ভাগ করে নে তোরা মেঘকে নিজেদের মতো করে। জিনিসগুলো দেওয়া-নেওয়া করে আমাকে উদ্ধার কর।
অনুর মুখের সেই হাসিটা দেখলাম কর্পূরের মতো উবে গেল।
“ওগুলো দিতে পারবো নারে সরি, আর কিচ্ছু ফেরতও চাই না,” বলেই অনু বেশ ব্যস্ততার সাথেই উঠে গেল সেখান থেকে। রাইও অনুদি অনুদি বলে পেছন পেছন ছুটলো।
আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম মেঘের দিকে। মেঘের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে মেঘ এবার আমার পাশে এসে বসে একটা সিগারেট ধরালো। আমাকেও একটা অফার করলো। কি মনে হল নিয়েই নিলাম। দু-তিন টান দেওয়ার পর নিজেই বলে উঠলাম- কি যে হচ্ছে এসব, কিছুই বুঝতে পারছি না।
“আমি বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি?” মেঘ আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়লো।
– ফ্লিপকার্টে আজ নিশ্চয়ই বিগ বিলিয়ন ডের অফার চলছে? শুনি কি বোঝাতে পারেন।
– সমাজে এরকম কয়েকজন আছে জানেন, সামনে আপনি আপনি বলে সম্বোধন করলেও পেছনে তুই-তুকারি আর খিস্তিতে ভরিয়ে দেয়”
– হ্যাঁ, উদাহরণ তো আমার পাশেই বসে আছে।
মেঘ একটু হাসলো। তারপর জোরে একটা টান দিয়ে আবার শুরু করলো…
– মাসদুয়েক আগে থেকে আমি আর রাই রিলেশনে।
– মানে? দু মাস! কোথায় রাই কিছু বলেনি তো।
– শুনেছি আপনার মেসোকে তো আপনিও ভয় পান।
– ইয়ে মানে তাতে কি হল?
– আপনার কাছে আমার ইমেজ তো একদম ডাউন। এবার সম্পর্কটার ব্যাপারে আপনি জানলে নিশ্চয়ই সেটাই করতেন। যেটা প্রতিটা দাদা তার বোনের ভালোর জন্যে করে। আমাদের সম্পর্কটা কি থাকতো তবে?
– কিন্তু একই সাথে দুজনকে ভালোবাসা, চিট করা হয় না?
– আপনি আপনার অনুকে ভালোবাসেন?
– সেসব আবার কেন?
– ভালোবাসেন?
– হ্যাঁ।
– অন্য কাউকে কি সেভাবে ভালোবাসতে পারবেন?
– না, কিন্তু…
– হ্যাঁ সেটাই। আমি রাইকেই ভালোবাসি। আর অনু আমার খুব ভালো বন্ধু। হ্যাঁ বন্ধু, আমি ওকে বান্ধবী ভাবিনি কোনোদিন। মনে রাখবেন, প্রত্যেকটা মানুষের প্রতি ভালোবাসার সংজ্ঞা আলাদা আলাদা হয়। আপনি অনুর কাছে যে জায়গাটা জুড়ে, সে জায়গায় যাওয়া তো দূর, ইচ্ছেও প্রকাশ করিনি কোনোদিন।
– তাহলে সেই প্রপোজটা?
– দেখুন আই লাভ ইউ বলা, আর সেই বিশ্বাসটাকে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে অনেক অনেক তফাৎ আছে। ভালো লেগেছিল, বলে দিয়েছি। একসময় প্রপোজ করেছিলাম মানে ওর প্রতি আমার সারাজীবন সেই মনোভাবটাই কায়েম থাকবে সেটা ভুল। এক্কেবারে ভুল।
মেঘ থামলো, আরেকটা ধরালো। আমিও আরেকটা চেয়ে নিলাম। ভাবতে পারছি না। এই মানুষটাকেই কিছুক্ষণ আগেও অসহ্য মনে হচ্ছিল।
– তাহলে অনুর আমাকে ওসব ফটো পাঠানো, রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস, গিফট রিটার্ন করতে বলা। এসব?
মেঘ এবার জোরে হেসে উঠলো।
ধোঁয়া ছেড়ে বলা শুরু করলো-
– ওহে বন্ধু, প্রেমিকার অভিমান যদি না বোঝো তবে প্রেম কিভাবে বুঝবে?
– হেঁয়ালি করিস নাতো। আমি জানি তুই লিখিস-টিখিস। কিন্তু আমার ওসব ঘোরালো কথা সত্যিই মাথার উপর দিয়ে যায়।
– যে তোকে খুব খুব ভালোবাসে, তাকে যদি তুই দিনের পর দিন সন্দেহ করিস, কথায় কথায় একটা মিথ্যেকে নিয়ে ঝগড়া বাঁধাস, তাহলে কি সে অভিমান করবে না?
তুই কি ভাবতিস? তোর অনু কিছুই বুঝতো না? আমাকে সব বলতো মনমরা হয়ে। ভেবেছিল একবার আমার সাথে বন্ধুত্বই শেষ করে দেবে শুধু তোর জন্যে। আমিই ওকে সান্ত্বনা দিতাম এই বলে যে তুই নিজে থেকেই সব বুঝবি একদিন।
– অনু তো আমাকে নিজে থেকেও বলতে পারতো এসব।
– অনেকবার অনেকভাবে বলেছে। কখনও সেগুলোকে পাত্তাই দিস নি। কখনও মিথ্যে ভেবে আরও সন্দেহ করা শুরু করেছিস। আর আজকাল তো সন্দেহটাকে এমনভাবে বিশ্বাস করে ফেলেছিস যে অনু বলা মাত্রই সব জিনিসপত্র নিয়ে ব্রেকআপ করতে চলে এলি।
– কিন্তু ইয়ে মানে…
– ইয়ে মানে ইয়ে মানে করার আগে ভালো বন্ধু হতে শেখ।
– কিন্তু কিভাবে?
– এই যেমন ভাবে আমরা আপনি থেকে তুইতে চলে গেলাম।
দু’জনেই হেসে উঠলাম খুব জোরে। নাহ, মেঘ ছেলেটা অতটাও খারাপ নয়, হঠাৎ অনুর কথা মনে পড়ল। সেখান থেকে উঠেই রীতিমতো দৌড় লাগালাম। ছুটলাম গেটের দিকে।
একটু এগিয়ে দেখি রাই আর অনু রাস্তার বেঞ্চিতে বসে আছে। রাই আমাকে দেখে এবার তেড়ে এলো। ভীষণ রেগে আছে মনে হচ্ছে। রাই কিছু বলার আগেই আমি রাইকে বললাম- মেসো কিন্তু খুব রাগি, তবুও সব দায়িত্ব আমার। রাগ নিমেষে গলে জল। বললাম – যা তুই ওদিকে, এদিকটা আমার উপর ছেড়ে দে।
রাই চলে যেতেই আমি গিয়ে বসলাম অনুর পাশে। বসার সাথে সাথেই অনু মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি হাতটা ধরলাম। ছাড়িয়ে নিতে চাইছিল কিন্তু বেশ শক্ত করেই ধরলাম। অনু এবার মুখ ফেরালো। কাজল সব লেপ্টে আছে, চোখ মুখ লাল। ভারী গলা নিয়েই বলল-
– মেঘকেই তো ভালোবাসি আমি। যা তুই, চলে যা। এসেছিস কেন?
আমি চুপ করে চেয়ে রইলাম ওর দিকে। ও আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। কিছুক্ষণ এভাবেই বসে থাকার পর হাতটা শিথিল করতেই ও হাতটা জোরে চেপে ধরে আমার কাঁধে মাথা রেখে কান্না শুরু জুড়লো।
আমাকে অবাক করে কাঁদতে কাদতেই বললো- “কেন বুঝিস না তুই? কেন বারবার ভুল বুঝিস?”
অনুকে এবার কাছে টেনে কপালে একটা চুমু খেলাম। আসতে করেই বললাম,
– আসলে আমাদের মাঝে কেন মেঘ আসে বলতো? কারণ আমি তোর ভালো বন্ধু হওয়ার সুযোগ পাইনি কখনও। আর তুই আমাকে প্রেমিক ছাড়াও ভালো বন্ধু ভাবতে পারিস নি কোনোদিন তাই। আজ থেকে যা খরচা সব অর্ধেক, বন্ধুদের মধ্যে যেমন হয়। আজ থেকে খিস্তি দিবি আমাকে, বন্ধুদের যেমন দিস, আজ থেকে আমি আগে বন্ধু, তারপর প্রেমিক। নে চোখ মোছ, পাগলীটা।
– কাল রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস, মেঘের সাথে ডিপি ওগুলো দেখে খুব কেঁদেছিস তাই না? ভেবেছিলাম তোকে একটু রাগাই। এবার তুই ব্যপারটাকে এত সিরিয়াসলি নিয়ে সবকিছু ডি-অ্যাকটিভেট করে দিবি ভাবিনি রে। ঘুম হয়নি সারারাত আমারও…
– ছাড় ওসব, আইসক্রিম খাবি? তবে আগে চোখ মোছ।
– রুমাল আনতে ভুলে গেছি।
– আমার জামায় মোছ। এমনিই তো ভিজিয়ে শেষ করেছিস।
– হে হে, ওই, ওই গানটা একবার গা না। “মাঝে মাঝে তব দেখা পাই…”
– গানে ‘মেঘ’ আছে বলে?
এবার আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম খিলখিলিয়ে, একটা সম্পর্ক হেসে উঠলো আবার। রাইয়ের কথা জানি না, তবে আমার আর অনুর সম্পর্কে মেঘের আনাগোনা চিরতরে শেষ হয়ে গেল এখানেই। অবশেষে বুঝতে পারলাম- মেঘেরা তো আসেই, আবার চলেও যায়। আকাশটা নীলই থেকে যায় শেষমেষ…
*** সমাপ্ত ***