কিছু ঘটনা আপেক্ষিক দৃষ্টিতে অবৈধ বলে মনে হলেও তার মধ্যে কোনো কলুষতা থাকে না। যেমন এহানি প্রাপ্তি ও অঞ্জনের সম্পর্কের ভুল মূল্যায়ন করলো। যাই হোক, ঘোড়ায় চড়ার অভিজ্ঞতা প্রাপ্তির জীবনে এই প্রথম। হুট করে রাজি তো হয়ে গেল, কিন্তু ভিতর ভিতর একটা লজ্জা কাজ করছিল। একটু বাধ বাধ ঠেকছিল বটে কিন্তু অঞ্জন সত্যি অমাইক মানুষ, তার মার্জিত আচরণ প্রাপ্তির সব সংকোচ কাটিয়ে দিল।
মিরিক এসে মোমো খাবে না — এ যেন নুন ছাড়া আলুভাতে। সবাই গিয়ে ভিড় করলো একটা ছোট্ট ঘুমটিতে। দোকানের সামনে ছোটো ছোটো তিনটে বেঞ্চ পাতা, একটা বড়ো আঁচের উনুন, তাতে বসানো তিন থাকের মোমো স্টিমার। জালার মতো অ্যালুমিনিয়ামের স্টিমারটার নীচের অংশটাই প্রায় দু’ফুট, তার ওপর আবার এক বেগদা উচ্চতার দুটি ঝাঁজরি। সুপ ফুটছে অনবরত, তার ভাপেই সিদ্ধ হচ্ছে ওপরের ঝাঁজরিতে থাকা ময়দা ও সবজি সহযোগে গড়ে তোলা অনবদ্য শৈল্পিক সৃষ্টি— মোমো। প্লেটে প্লেটে চলে এসেছে চারটে করে গোল আকারের ভেজ মোমো আর একবাটি করে সুপ, সঙ্গে টক ঝাল স্পেশাল আচার। সবাই যখন মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে জিভের আশ মেটাতে ব্যস্ত তখনই একটা নাম শুনে চমকে উঠলো প্রাপ্তি। একজন হুডি পরে অনেকটা দূরে চলে গেছে। সেই ডাকলো কি? এদিক ওদিক তাকালো, কিন্তু চারপাশে আর তেমন কেউ তো নেই!
বিকেলে আশ্রমে ফিরে সবাই খুব ক্লান্ত। এদিকে দীনেশ বাবু তার সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের সব আয়োজন করে রেখেছেন। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার কেক কাটা, হুল্লোড়, রাতের খাওয়াদাওয়া। এহানি এসেই ঘরে খিল দিয়েছে, ওর খুব মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে। কেক কাটার সময়ও আসেনি। এর মাঝে অঞ্জন প্রাপ্তিকে গান শোনানোর কথা মনে করিয়ে দিল। সেও অস্বীকার না করে একটা গান ধরলো বটে, কিন্তু ওর মন বড়ই অস্থির— “কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে ডাকে আমায়…” প্রাপ্তি কি সত্যিই কোনো আলোর রেখা খুঁজে পেল! নাহলে হঠাৎ করে কেন এমন চঞ্চল হয়ে উঠলো শান্ত মেয়েটা? অনুষ্ঠান শেষে বাচ্চাদের নিয়ে অন্য মিসরা ব্যস্ত। আর প্রাপ্তি ব্যস্ত কুঁড়িকে খাওয়াতে। অনেকক্ষণ থেকে অঞ্জন দূর থেকে লক্ষ করছে কুঁড়ি কিছুতেই খেতে চাইছে না, আর প্রাপ্তি কেমন গল্প করে, আদর করে সস্নেহে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। কুঁড়িকে খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে প্রাপ্তি যখন ওর ঘর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে, অঞ্জন এসে বলল
– একটু দাঁড়ান!
– হ্যাঁ, বলুন!
– কুঁড়ি ঘুমালো?
– ওকে ঘুম পাড়িয়েই আসছি।
– খেয়েছেন?
– না না, আমি তো রোজ কুঁড়িকে খাইয়ে তবে খাই। এই তো এবার যাবো খেতে। তা আপনার খাওয়া হয়েছে?
– আপনি সত্যিই কুঁড়ির মাম্মাম।
প্রাপ্তি সলজ্জ মুখে একটু ইতস্তত হেসে কোনো উত্তর না দিয়েই চলে গেল।
রাতে খাওয়ার পর পায়চারি করা অঞ্জনের প্রতিদিনের অভ্যাস। আশ্রমের চারিদিকটা একবার চক্কর দিয়ে সে নিজের ঘরেই ফিরছিল। এহানি বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে অঞ্জন এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল
– এখন কেমন আছেন?
– ভালো
– এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো!
– আমার কথা চিন্তা করেন তাহলে!
– হঠাৎ এমন কথা?
– ভেবেছিলাম কেক কাটার সময় ডাকবেন, খোঁজ পর্যন্ত নিলেন না!
– এ মা, ছি ছি! কুঁড়ি অনেকবার আপনাকে খুঁজেছে, ললিতা মিস বললেন আপনি অসুস্থ। তাই আর ডিস্টার্ব করিনি।
– বুঝলাম।
– কী বুঝলেন?
– এই যে কুঁড়ি আমার খোঁজ করেছে। আর কেউ নয়।
– ভুল বুঝেছেন ম্যাডাম, সম্পূর্ণ ভুল।
– তাহলে ঠিক টা কী?
– আপনি এখন ঘরে গিয়ে রেস্ট নেবেন, এটাই হবে ঠিক।
– অর্ডার করছেন?
– অনুরোধ।
– যদি না যাই?
–কিছুই না! আমার কথা শুনলে আপনারই ভালো, আর আমার ভালো লাগতো, এই যা!
এহানি কোনো দিনই অঞ্জনের কথা ফেলতে পারেনি, আজও পারলো না। “গুড নাইট, আপনিও গিয়ে শুয়ে পড়ুন”— কথাগুলো বলে এহানি নিজের ঘরে চলে গেল।
আশ্রমে নেমে এসেছে শান্ত ঘুমের চাদর। জেগে আছে শুধু বিচিত্র তিন জোড়া চোখ। হাজার হাজার সম্ভাব্য কারণ স্তূপ হয়ে জমছে মনের ভিতর। জলে ভেসে থাকা বর্শির ফতনার মতো করে কাঁপছে তিনটি কলিজা। এই বুঝি আসন্ন শিকার নাগালে এলো।
ওই নাম ধরে কে ডাকলো প্রাপ্তিকে? নাকি সবই ওর মনের ভুল! তবে সত্যিই কি সে এতো দিন পর কথা রাখলো?
“সত্যিই আপনি কুঁড়ির মাম্মাম”— কথাটা শুনে প্রাপ্তি হাসলো কেন? তবে কি সেও অঞ্জনের মতো একই স্বপ্ন দেখে!
এহানির ঠান্ডা লাগলো নাকি অসুস্থ হলো সেই নিয়ে অঞ্জনের কীসের চিন্তা? এহানির মতো অঞ্জনও কি তবে এহানির প্রতি দূর্বল!
ক্রমশ…
– অর্যমা