দূর্গাপুজো, সন্দীপ আর সেই মেয়েটা – তৃতীয় পর্ব

পুজো আসবে, পুজো আসবে— এটাই যেন আনন্দ। একমাস আগে থেকে কত্ত প্ল্যানিং, দোকানে দোকানে নতুন জামা-জুতো কেনার হিড়িক, বিশেষ বিশেষ পুজো প্যান্ডেলগুলো ঘুরে দেখার ইচ্ছে— ওসবেই যেন উৎসবের আসল মজাটা লুকিয়ে থাকে। নয়তো পুজোর এই চারটে দিন যেন খুব তাড়াতাড়িই কেটে যায় সবার।
কাল ষষ্ঠী কেটে গিয়ে এখন সপ্তমীর রাত, অথচ সারাটা সময় কোথা দিয়ে কেটে গেল বোঝারই উপায় নেই। আজকের মতো পুজো সমাপ্ত। বাড়ির এতবড় ছাদটায় সন্দীপ এখন একা। প্রকাশ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে কি একটা কাজ মিটিয়ে। মোবাইলটা বের করে প্রকাশকে রিং করলো সন্দীপ, ফোন তুলছে না। এদিকে একটু শীত শীতও
লাগছে। এখনও অবধি প্রকাশের সাথে ভালোমতো কথা হয়নি তার। প্রকাশরা পুজোর জোগাড়যন্ত্রে এমনিই খুব ব্যস্ত, কাজে হাত লাগাতে হয়েছে সন্দীপকেও। তাই সেই মেয়েটাকে নিয়ে এখনও অবধি সেভাবে বিস্তরে কিছু আলোচনা হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই গতকাল সেই সকালের পর মেয়েটাকে বাড়ির এদিক সেদিক অনেক খুঁজেছে সন্দীপ। কিন্তু দেখা মেলেনি। মানুষ কি আর হাওয়ার মতো উবে যেতে পারে? প্রকাশকে গতকাল থেকে অনেক করে খবর নিতে বলেছে সে। কিন্তু সেই মেয়েটা সম্পর্কিত কথাগুলো প্রকাশ পাত্তাই দেয়নি, কখনও আবার বিরক্তিস্বরে “আচ্ছা, দেখছি…” বলেই পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। মেয়েটার ব্যাপারে কথা ওঠালেই প্রকাশ কেন এড়িয়ে চলছে সন্দীপকে? কোথাও কি কিছু গন্ডগোল আছে?

 

“সরি, দেরি হয়ে গেল, কিছু মনে করিস না।” —বলেই প্রকাশ মোবাইলটা বের করে কাকে যেন একটা ফোন করলো। আগামীকালের কি একটা বাজারের ফর্দ নিয়ে কথা বলল কিছুক্ষণ, ফোনটা রাখতেই সন্দীপ প্রশ্ন ছুঁড়লো প্রকাশের দিকে— “কিরে, কিছু খবর পেলি?”

– আচ্ছা, তুই ঠিক দেখেছিলিস বলতো? — প্রকাশের চোখমুখ কিছুটা ফ্যাকাসে।

– আরে, সবই তো বললাম তোকে, বয়সে আমাদের থেকে দু-এক বছর ছোটই হবে হয়তো।

– দেখ সন্দীপ, আমি যা শুনলাম, ব্যাপারটা কিন্তু অ্যাবনর্মাল।

– মানে? আমার কিন্তু দেখে মনে হয়নি মেয়েটা অ্যাবনর্মাল টাইপের কিছু।

সন্দীপের উত্তেজনা যত বাড়ছে, প্রকাশের মুখটা যেন ততই ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে প্রকাশ গম্ভীর মুখ করে বলল,
– প্যারানর্মালও বলতে পারিস।

– মানে?! কি যাতা বকছিস?! — কান গরম হয়ে গেল সন্দীপের।

– দেখ, আমি যা শুনেছি, তা শোনার জন্যে তোর সাহস দরকার।

– সাহস মানে? দেখ, ইয়ার্কি না করে সত্যি কথা ব…

– ইয়ার্কি করছি না! — প্রকাশের চোখ মুখ উদ্বেগে ভরা। তার চোখ থেকে যেন ঠিকরে বেড়িয়ে আসছে ভয়! সন্দীপ যেন এবার কিছুটা দমে গেল, গলা জড়িয়ে আসছিল, ধরা গলাতেই বলল,

– তুই কি বলতে চাস? আমি ভূত দেখেছি?!

– যতটা তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা মেনে নিতে পারবি, ততই তোর পক্ষে ভালো হবে। দেখ, ভূত আছে কি নেই, সে ব্যাপারে আমি আলোচনা করতে চাই না, কিন্তু সেরকম কোনো মেয়ে আমাদের বাড়িতে আসেইনি, আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি।

– আরে তোদের বাড়ি না হোক, হয়তো পাশের বাড়ির কারোর বাড়িতে ঘুরতে এসেছে। মেয়েটা হয়তো মিথ্যে বলেছে…

– কিন্তু এ বাড়ির গল্পের সে চরিত্রের সাথে সেই মেয়েটার বর্ণনা যে একেবারে মিলে যায়! তার বেলা? — বড় বড় চোখ করে বলেই ফেলল প্রকাশ।

– গল্প? কিসের গল্প? —সন্দীপের যেন নড়ার শক্তি নেই।

– গল্প ঠিক নয়, ইতিহাস। আজ থেকে বছর পঁচিশ আগের ঘটনা। তখন আমি জন্মাইনি। পুজো দেখতেই এসেছিল মেয়েটা এ বাড়িতে, বড় পিসির কি রকম একটা রিলেটিভ হতো।

– তারপর?!
– ডিপ্রেসড্ ছিল কিনা জানা যায়নি, ওই ওখান থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল ষষ্ঠীর রাতে!

ছাদের কোণাটার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে দুজনেই। সন্দীপ এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে, মেয়েটা বছর পঁচিশ আগেই…!

– তারপর থেকেই, প্রতিবছরই নাকি আসে… দশমীর পর আর দেখতে পাওয়া যায় না।
ভীষণ চাপা কিন্তু বেশ জোর দিয়েই বলল প্রকাশ।

– তাহলে, সেদিন তোর দেখতে না পাওয়ার আসল কারণ ওটাই!

– কিছু যে ক্ষতি হয়নি এটাই অনেক।

সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসতে আসতে প্রকাশ অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেল, কিন্তু সন্দীপ থম মেরে গেল একেবারে। কাল অষ্টমী। মেয়েটা যদি সত্যই অশরিরী হয়ে থাকে তবে এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওদের কথোপকথোন সবটা শুনে নিয়েছে। সন্দীপকে কি আবার দেখা দিতে পারে মেয়েটা?

বিছানায় শুয়ে প্রায় সারারাত এপাশ ওপাশ করলো সন্দীপ। মেয়েটার কথা ভাবলে গায়ে যেন এখনও কাঁটা দিচ্ছে… প্রকাশ এদিকে অঘোরে ঘুম। জন্মের পর থেকে যেহেতু সেই ঘটনা শুনে আসছে, তাই হয়তো তার সেরকম উদ্বেগটা আর নেই! কিন্তু সন্দীপের পক্ষে কি এসব মেনে নেওয়া সহজ ব্যাপার? এর চাইতে বাড়িতে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিত এবার পুজোটা, এরকম একটা ঘটনার সাক্ষী তাকে থাকতে হবে কেই বা জানতো?

***

আজ অষ্টমী। কাল রাতে কখন ঘুম এসেছে জানে না সন্দীপ। কিসের যেন একটা অস্বস্তিবোধ চোখের পাতাদুটোকে এক হতেই দিচ্ছিল না। চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছিল মেয়েটা যেন তার দিকে চেয়ে হাসছে। ঠিক করলো আজ বিকেলের ট্রেনেই ফিরে যাবে সে, কাউকে কিছু না বলেই। আপাতত সকালটা স্বাভাবিকভাবে কাটিয়ে দিতে পারলেই হল।
স্নান করে আজ একটা লাল রঙের পাঞ্জাবী পরলো সে, নীচে নেমেই দেখতে পেল প্রকাশদের। প্রকাশ আজ এক্কেবারে স্বাভাবিক, সন্দীপের সাথে যেন সেরকম কিছুই ঘটেনি। ওকে দেখেই এগিয়ে এল, মস্করা শুরু হল নানা বিষয় নিয়ে, জমে উঠলো অষ্টমীর সকালটা…
অঞ্জলির জন্যে ডাক পড়তেই প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট জন প্রতিমার সামনে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল, বাচ্চারা ছুটোছুটি শুরু করেছে সবার আগে দাঁড়ানোর জন্যে, প্রায় যুদ্ধ করে ডালি থেকে কয়েকটা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে সন্দীপ দাঁড়ালো শেষের একটা সারির কোণার দিকে। পুরোহিত মন্ত্র বলা শুরু করলো, সন্দীপ চোখ বন্ধ করতে যাবে, এমন সময়…

সন্দীপদের সারির ঠিক আগের সারিতে একটি মুখ চোখ বন্ধ করে মন্ত্র পড়ে যাচ্ছে সবার সাথে, মুখটা সন্দীপের খুব চেনা। চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, সেই লাবণ্যময়ী মুখ, সেই মেয়েটা!
সবার এখন চোখ বন্ধ শুধু সন্দীপ যেন হাতে ফুলটা নিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে একদৃষ্টে দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে চেয়ে, ভেতরে একটা কেমন ভয় যেন উঁকি দিচ্ছে, গায়ে আবার কাঁটা দেওয়া শুরু হয়েছে…
মন্ত্র শেষ হতেই সবাই যখন প্রতিমার দিকে ফুল ছুঁড়ছে, সন্দীপ হতবুদ্ধি হয়ে কি মনে করে মুঠোভরতি ফুলটা মেয়েটার দিকে ছুঁড়লো। দু-একটা ফুল গায়ের সামনে পড়তেই মেয়েটা এদিকে তাকালো, সবাই ছুটলো আবার ফুল কুড়োতে, সন্দীপ আর সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে রইল একে অপরের দিকে চেয়ে। ব্যাপারটা এতই তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে আর কেউ সেদিকে খেয়ালই করলো না।
সবাই আবার চোখ বুজে মন্ত্র বলতে শুরু করেছে, মেয়েটা সেখান থেকে সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে… ভয়ে কথা বলতে পারছে না সন্দীপ।
মেয়েটা গতি বাড়ালো, আর দেরি করা চলে না, ফিরেই যখন যাবে তখন এত ভয় কিসের? কাঁপা কাঁপা পায়ে সন্দীপ দ্রুত পিছু নিল মেয়েটার…

সবাই অঞ্জলিতে ব্যস্ত, শুধু বারান্দার একপাশ দিয়ে এখন রুদ্ধশ্বাসে প্রায় ছুটে চলেছে, সন্দীপ আর সেই মেয়েটা…

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *