চরিত্র কাহন

বেশ্যা পাড়ার একটি ঘরের ভিতর থেকে জোরে আওয়াজ এলো, “চরিত্র-হীন শালী! ভালোবাসার কথা বলছিস, টাকার বদলে তোর সাথে যে শুই এই তোর ভাগ্য। আদিখ্যেতা দেখাতে এসেছে”… বলেই লোকটি বেরিয়ে গেল। আর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছে রাণী তৈরী হল পরের খদ্দেরের জন্য।

সৃজন এবং শ্রী-র দেড় বছর সম্পর্ক কেটে যাওয়ার পরেও সৃজন উপলব্ধি করে, মনের কোণে কোথাও রিহানা-র প্রতি ভালোলাগা উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু ও জানে না এটা কি ভালোবাসা! সৃজন মন খুলে শ্রী-কে সব জানিয়েছে আর তকমা পেয়েছে ‘চরিত্রহীন’-এর।

‘চরিত্রহীন মেয়ে’- বলেই ঠাস করে একটা চড় মারল কুহুর মা।
“লজ্জা করে না? বিয়ের আগেই মা হওয়ার কথা ভেবে নিলি! রাহুল তো বলেই দিয়েছে সে তার মায়ের অমতে গিয়ে তোকে বিয়ে করবে না। এবার সমাজে মুখ দেখাবো কী করে?”

…উপরের প্রত্যেকটা পরিস্থিতি ঘোর বাস্তব এবং প্রতি ক্ষেত্রে একটি শব্দ আছেই; “চরিত্রহীন!”
কিন্তু প্রশ্ন একটাই রাণী, সৃজন, কুহু বা এদের মত প্রত্যেকটা মানুষই কী “চরিত্রহীন?…”

“চরিত্রহীন” একটা শব্দ, যার অর্থ এক এক জনের কাছে এক এক রকম। প্রগতিশীল ইয়ং জেনারেশনের কাছে চরিত্রহীন তারা, যারা ধর্মের নামে নোংরামো করছে আবার নারীবাদী মনের কাছে প্রায় সমগ্র পুরুষ জাতিই  চরিত্রহীন। কিন্তু সব কিছুর ঊর্ধ্বে আমাদের “সমাজ”, যার কাছে  “চরিত্রহীন” আর “নারীজাতি” প্রায় সমার্থক।
তবে যাই হোক না কেন, কোথাও গিয়ে একটা ধারণাতে আমরা সবাই থমকে যাই; একটি ছেলে বা মেয়ে কতজনের সাথে সহবাস করল, সেটাই তার চরিত্রের মাপকাঠি হিসেবে পরিচিত হয়।

বেশ্যা পাড়ায় শরীর বেচার কাজে লিপ্ত থাকা রাণীর মতো মেয়েরা প্রতি দিন স্বপ্ন দেখে ভালোবাসার। তাদের শরীর নিংড়ে যায় প্রতিদিন প্রচুর “ভদ্রলোক”, তাও তারা “সভ্য” সমাজের কাছে চরিত্রবান। পরনারীর শরীরী সুখ ভোগ করা তো তাদের অধিকার। কিন্তু শরীর বেচে দেওয়া মেয়েগুলো তো শুধুই ভোগ্য।

সৃজন চরিত্রহীন তখনই হত যদি সে শ্রী-কে ঠকিয়ে রিহানা-র সাথে সম্পর্ক রাখত। সে চরিত্রহীন নয়, তাই সে সাহস জুটিয়ে বলতে পেরেছে তার অনুভূতির কথা। ভালোবাসা কাউকে বলে আসেনা, তাই একসাথে দুজনকে ভালোবাসাটা অন্যায় এটা অন্য কেউ ঠিক করার অধিকারও কারোর নেই।

কুহুর মতো হাজারো মেয়ে প্রতিদিন বলি হয় “ভালোবাসার” কাছে। ভালোবাসা ধরে রাখতে নিজের সম্মানহানি করিয়েও সে চরিত্রহীন,  কিন্তু তার “ভালোবাসা” বাধ্য ছেলে।

আসল চরিত্রহীন তো তারাই যারা অসহায় মনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রতিদিন ছারখার করে দেয়, যারা কারোর বিশ্বাসকে অবলীলায় ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়, যারা ভালোবাসা শব্দটা থেকে বিশ্বাস ভরসা তুলে নিতে বাধ্য করে। চরিত্র শব্দটা বড়ই আপেক্ষিক, যার গ্রহণযোগ্যতা বিচারের মাপকাঠি আজ সমাজ নামক আদালতের হাতে।

চরিত্রহীন বলে অপবাদের শিকার শুধুই মেয়েরা নয়, ছেলেরাও হয়।
রাণী, সৃজন, কুহু বা এদের মতো প্রত্যেকে সমাজের কাছে চরিত্রহীন হলেও, নিজেদের কাছে এরা সৎ; আর এটাই এদের শক্তি।
তারাও লড়ে যায় এটা বোঝাতে যে তারা চরিত্রহীন নয়; লড়াই শেষে হেরে খালি হাতে ঘরে ফিরে আসে আর জিতে যায় “সচ্চরিত্র” নামের মুখোশের আড়ালে থাকা শত শত মানুষ।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *