“মনে রবে কিনা রবে..”
আগরপাড়া থেকে ট্রেনে শিয়ালদহ যেতে তিরিশ মিনিট সময় লাগে। প্রতিদিনের কলেজ, পড়ানো— এসবের জন্য রোজই এই সময়টা ভিড়ে যুদ্ধ করেই কেটে যায়। দরজায় ঝুলতে চাওয়া আর সীটে বসতে চাওয়ার লড়াইয়ের মাঝেই কেটে যায় এই তিরিশ মিনিট। “রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা!” —তাই ট্রেনে কে, কাকে, কী বলছে তা আর কেউ মনেও রাখেনা। কিন্তু কখনো কিছু ঘটনা এমন ঘটে যা মনের কোণে তার প্রতীক চিহ্ন রেখে যায়।
সাড়ে দশটার পর থেকে ট্রেনের ভিড় একটু কমতে থাকলে, ওই সময় সাধারণ ধুতি-ফতুয়া পড়া একজন বয়স্ক লোক কাঁধে জোড়া লাগানো হারমোনিয়াম নিয়ে একটি বাচ্চার সাথে ট্রেনে ওঠেন। বাচ্চাটির পরনে একটি নোংরা হাফ প্যান্ট এবং একটি শার্ট। তার চোখেমুখেই ফুটে ওঠে দৈনিক অভাব এবং তার বুদ্ধিমত্তা। অন্যান্য দিন দশটার আগেই যাওয়া হয় বলে এ দৃশ্য চোখে পড়েনা, তাই ওদের দেখে সিডি বাজিয়ে গান করার দলেই মনে মনে ওদের নামটাও জুড়ে দিয়েছিলাম।
স্টেশন থেকে ট্রেনটা ছাড়তেই হারমোনিয়ামের সুরটা বেজে ওঠে আর তার সাথে জোরালো হয় এক অনবদ্য কন্ঠস্বর। ফোন থেকে চোখ তুলতেই দেখলাম বাচ্চাটি তার দরাজ গলায় গাইছে এক লোকসঙ্গীত। সবাই গল্প-কাজ ফেলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে তার গান আর মনে মনে সুর মেলাচ্ছে।
গান শেষ হতেই যেন নেশামুক্ত হয় সবাই। তারপরই শুরু হল প্রশংসার বন্যা আর টাকা দেওয়ার পালা। প্রশংসায় সবাই এগিয়ে থাকলেও, সবাই যে টাকা দেবে তা আশা করাও বৃথা।
একজন যাত্রী— “আর একটা গান করনা রে, কি দারুণ গাইলি…”
বাচ্চা— “না গো না। সকাল তেকে একোনো টিপিন করিনি। আমিও তো মানুষ বলো!”
— “আচ্ছা আচ্ছা, সে তো ঠিকই। তা তোর নাম কী রে ছেলে?”
— “পিয়াংকা, ডাকনাম রীতা। আমি ছেলে শিশু না গো। মেয়ে। এভাবে থাকি তাই সবাই ছেলেই ভাবে।”
সবাই কেমন অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়, প্রায় একসাথে অনেকে বলে ওঠে, “তুই মেয়ে?”
— “হ্যাঁ গো হ্যাঁ।”
— “তাই তুই ওই সারেগামাপা… ওসব অনুষ্ঠানে যেতে পারিস তো। একবার যেতে পারলেই ভাগ্য খুলে যাবে রে। আরে, ওই যে তুলিকা! সেও তো এরকম করেই গাইত, কালিকাপ্রসাদ খুঁজে এনেছিল।”
— “আমি বেশিদিন বাঁচব না গো।”
— “যা! এরকম বলতে নেই।”
— “হ্যাঁ গো সত্যি। আমার মায়ের ক্যান্সার, বাবা অনেকদিন হলো মারা গেছে। এক দাদা আছে, সে শ্বশুরবাড়ি থাকে আর দিদিরও বিয়ে হয়ে গেছে। কে, কী বলবে তাই কারো কাছে চাইতেও লজ্জা করে। তাই এভাবে রোজগার করি। চাইতে পারিনে, তাও বলছি… গান ভালো লাগলে কিছু পয়সা দিও।”
এসব শুনে আরও কেউ কেউ টাকা দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তারপর একটা ফাঁকা সিটে বসে ছেলেটি আবার একটা গান শুরু করে।
খুব বেশি হলে মেয়েটির বয়স হবে বছর ৯ কি ১০। কিন্তু তার পরিশ্রম আর নিষ্ঠা মোটেই ওই বয়সের নয়। যদিও হবেই বা কী করে? যেখানে আঠারো পার করেও আমরা ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে মশগুল হই, কিংবা খাবার মুখে না রুচলে ফেলে দিতে দ্বিধা বোধ করিনা; সেখানে এই দশ বছরের মেয়েটি বাড়ির ছেলে হয়ে ওঠার চেষ্টায় প্রতিদিন ব্রতী। যেখানে বাড়ির আসল ‘ছেলে’ কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছে, সেখানে ছেলে হয়ে ওঠার লড়াইয়ের মাঝে মেয়েটি সমাজের কাছে আত্মসম্মানের উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
শিয়ালদহ স্টেশন আসতেই তড়িঘড়ি সবাই নেমে যায় আর শূন্য কূপের প্রতিটি কোণে লেগে থাকে রীতার সুর আর বেসামাল জীবন সামলে ওঠার গল্প।।