শংকরের “চৌরঙ্গী”। এই বইটা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে বর্তমান বছরে, কারণ অবশ্যই শ্রীজিত মুখার্জির বাংলা অ্যাডাপ্টেশনটা। কিন্তু বাঙালী পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে শুধুই কী সিনেমার দৌলতে এত নামডাক নাকি আরও কিছু আছে।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে মন চাইছিল। তাই এবারের বইমেলাতে গিয়ে যখন বইটা দেখলাম, কিনতে আর দেরি করিনি। বইটার একটা মাত্রই কপি পড়েছিল, যেন আমার জন্যই। বইটার বর্তমান যুগের প্রাসঙ্গিকতা আর নতুন করে উত্থানের রহস্য খোঁজ করতেই বইটা পড়তে শুরু করি।
নাম: চৌরঙ্গী।
লেখক: শংকর।
দাম: তিনশ পঞ্চাশ টাকা।
পাবলিশার্স: দেজ পাবশিশিং।
কোথায় পাওয়া যাবে: কলেজ স্ট্রিটের যে কোনো পুরানো গল্পের বইয়ের দোকানে।
শংকরের “চৌরঙ্গী” – বইটার নাম অনেকবার শুনলেও আগে তেমন মনে দাগ কাটেনি। তবে বাংলা সিনেমাতে এই গল্পের ব্যবহারের ইঙ্গিত পেয়ে মন ভাবতে বসে। কী এমন সেই প্লট যার জন্য গল্পের প্রকাশের সাতান্ন বছর পরেও তার দাম একটুও কমেনি।
গল্পের প্রধান চরিত্রের নাম শংকর। আগে অফিসে চাকরি করত কিন্তু বর্তমানে বেকার। হঠাৎই সে হোটেল “শাজাহান” এ চাকরি পায়। তার চারধারে উপস্থিত বিভিন্ন চরিত্র এবং ঘটা ঘটনাবলী নিয়েই এই উপন্যাস।
গল্পের শুরুটা এলোমেলো বলে পাঠকের খানিকটা অসুবিধা হয় আসল সূত্র ধরতে। তবে কিছুটা দূর গিয়ে পাঠকের কাছে ধীরে ধীরে সবটা প্রকাশ হয়। গল্পের প্রথম ভাগ খানিকটা বিরক্তিকর কারণ লেখক কোনো নির্দিষ্ট ঘটনাবলীর উল্লেখ না করে ক্রমাগত নানাধরনের বিশেষণ ব্যবহার করেছেন।
গল্পের মধ্যাংশ পাঠককূলের মনোযোগ আকর্ষণ করবেই। গল্পের প্রয়োজনে বিভিন্ন চরিত্রের আনাগোনা বেড়েছে।গল্প পড়তে পড়তে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য নজরে আসে। গল্পের প্রতিটি চরিত্র যেন জীবনের সাথে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত। যেন হন্যে হয়ে নিস্তারের পথ খুঁজছে।
শংকর যখন সদ্য চাকরিতে ঢোকে তখন একরকম ছিল। গল্পের শেষ ভাগে তাকে আমরা অন্যভাবে পাই। গল্প পড়তে পড়তে পাঠক শংকরের সাথে সাথেই নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। তার সাথেই আমরা বেড়ে উঠি।
লেখক “শাজাহান” হোটেলটিকে যেন রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। ছোটো হোটেলটা যেন আমাদের এই বিশাল পৃথিবী। এখানে কত মানুষের আনাগোনা। কত মানুষের সাথে পরিচয় হয়। কত মানুষের সাথে হৃদ্যতা বাড়ে তবুও চিরকাল কেউ থাকে না।
গল্পের প্রতিটা বাঁকে এক নতুন অধ্যায় আবিষ্কার করতে পারি আমরা যেখানে মানুষের পরিবেশ আর অসহায়ত্ব আমাদের থেকেও বেশি মনে হয়।
শংকরের “চৌরঙ্গী” এই 2019 এও সমান প্রাসঙ্গিক। লেখক নিজের দূরদৃষ্টি দ্বারা স্যাটা বোস, মার্কোপোলো, বায়রন সাহেব, করবী গুহ, রোজি, জিমি, হবস্ সাহেব, সরাবজী এবং অবশ্যই শংকর চরিত্র গুলিকে অমরতা দান করেছেন। সে যুগের কলকাতার বর্বরতা কিছুটা নিদর্শন পাই আমরা কনি চরিত্রটার মাধ্যমে। প্রভাতচন্দ্র গোমেজ যেন অতীতের গৌরবের প্রতীক।
সময় বদলেছে, যুগ পাল্টেছে তবুও শংকরের “চৌরঙ্গী” আজও অমলিন কারণ মানুষের মনের ভাব ব্যক্ত করতে আজও সে সমান পারদর্শী।
” Our life is but a winter’s day:
Some only breakfast and away;
Others to dinner stay and are full fed;
The oldest man but sups and goes to bed;
He that goes soonest has the least to pay.”
– A.C.Maffen