অন্তরমহল যদি বেআব্রু হয়ে যায়?
ঋতুপর্ণ ঘোষ বাংলা সিনেমা জগতে এক বিশাল ব্যাক্তিত্ব। যার সিনেমার খ্যাতি কিন্তু ভারতের বাইরেও হয়। সেদিন বেতারে একখানা জিনিস শুনছিলাম, ঋতুপর্ণ ঘোষের কাছে পুরস্কারের আনন্দটা সাময়িক ছিল। যার অন্তরমহল যত স্বচ্ছ সেই তো এমন ভাবনায় সামিল হতে পারে তাইনা?
অন্তরমহল এর মহামায়ার মনের কষ্ট সে কিন্তু নতুন বউয়ের উপর পড়তে দেয়নি। গোড়া থেকে দিদির মত আগলে গেছে। নিজের ক্ষতি হয় হোক তবুও যশোমতীর কোনোরকম খারাপ সে সহ্য করেনি।
মনে পড়ে? যশোমতীর কান্নার কথা? কারণ ভুবনেশ্বর চৌধুরী বাইরের পুরোহিতের সামনে তার সাথে বলপূর্বক সহবাস করে, কারণ? তার পুত্র চাই যেটা সে প্রথমা স্ত্রী মহামায়ার থেকে পায়নি বারো বছর পরেও। মহামায়া কিন্তু ছোটোবোনের মত তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে আগলে রেখেছিল আর হুকুম করেছিল যাতে পুরোহিতেকে অন্য ঘরে বসানো হয়।
যশোমতীকে কর্তার রোষ থেকে বাঁচানোর জন্য সে দরজা আগলে দাঁড়িয়েছিল। এ নিদর্শন অবশ্য আজকাল এই কুটকঁচালি জা এর সম্পর্কে পাওয়া মুশকিল। অন্তরমহল আসলে প্রকৃত ভিতরটাকে বেআব্রু করে দেখায়। নিজের জেদ বজায় রাখার জন্য ভুবনেশ্বর চৌধুরী নিজের বৌকেও অপরের কাছে শুতে পাঠাতে শেষ অবধি সম্মত হয়। অথচ বউয়ের কথা শুনলে তার নাকি ভারী সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে।
অন্তরমহল দেখার সময় নিজেকে কেমন যেন নতুন পটুয়াটার মতন মনে হচ্ছিল যার বড় বড় দুটো চোখ ভিতরটাকে ফুঁড়ে অন্তরটা দেখে নেয়। মা দুর্গার মুখ শিল্পী ছোটবউয়ের মুখের আদলে গড়ে প্রমাণ করলেন, শিল্পীর কোনও জাতধর্ম হয় না, সে বেঁচে থাকে শুধু তার শিল্পীসত্ত্বার মধ্যে।
বেড়ালের শাস্তির কথা মনে পড়ে? সে অন্তরমহল এর আঙিনা পার করে ছোটবউয়ের ঘরে ঢুকেছিল বলে, তার মৃত্যুদন্ড হয়। আসলে অনধিকার প্রবেশ করার সুযোগ কারোর নেই, এমনকী বাতাসও না। তার কোপ থেকে স্বয়ং জমিদারের পোষা বেড়ালও রেহাই পায় না।
হিঁদুয়ানী নিয়মের যে একটা মস্ত ফাঁক আছে সে বরাবরের চোখে আঙুল দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। জমিদার ভুবনেশ্বর চৌধুরী ব্রিটিশদের মন জুগিয়ে চলার জন্য যে পন্থা নিয়েছিলেন তার পাপস্খলনের নিয়ম অনুসারে বড়বউকে বামনদের সাথে শোওয়ার আদেশ আসে। অন্তরালে থেকে যায় তার বুকভরা নিঃশ্বাস।
সর্বশেষে বলি, আবহসঙ্গীতের একটা বিশেষত্ব থাকে প্রতিটি ঋতপর্ণ ঘোষের সিনেমাতে। চোখের বালিতে যার সর্বোচ্চ নমুনা পেয়ে মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। অন্তরমহল এও “গিরিপুরী সকলি আঁধার, কবে আসিবি আবার…” শেষ অবধি দুঃখের স্মৃতি বহন করে চলেছে, মা যেন বিসর্জনের কান্নার শেষ জলটুকুও শোকাতে দেয়নি।