বৃদ্ধালয়

বৃদ্ধালয় -এর সেই পুরোনো মালিকটা আমাকে দেখে চোখ বড়ো বড়ো করলেন।বুঝলাম উনি কি বলবেন,তাই উনার বলার আগেই আমি শুরু করলাম।আপনি ঠিকই চিনেছেন মালিক বাবু।আজ থেকে পঁচিশ টা বছর আগে এই আমাকেই আপনি দেখেছিলেন যৌবনে।আর আজ যৌবন,এবং পৌড়ত্ব পেরিয়ে বার্ধক্যের দৌড়গড়ায় উপস্থিত।

বাবা বেঁচে থাকাকালীন বুঝিনি,যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্ট করা হাতগুলো দিয়ে আগলে রেখেছিলো বলেই আমরা কোনো কষ্ট উপলব্ধি করতে পারিনি।চাহিদার পর চাহিদা মিটিয়ে গেছে।তবু কোনোদিন ও মুখের ওপর “না” বলেননি।হয়তো সে জন্যেই আমার মতো ছেলেরা এত পাপের বোঝা বইছে।

(ছবি – সংগৃহীত)

কোনো কোনো দিন খাবার ঠিকমতো জোটেনি, কিন্তু আমি তার একাংশ কষ্ট ও ভাগ করিনি বাবার থেকে।
বুঝতেও পারিনি আমাকে পেট ভরে খাওয়ানোর জন্য বাবা কত কত দিন উপোষ গেছেন।মিথ্যা কথার ফাঁকে জরিয়ে যেতাম আমি। হ্যাঁ,বাবা বলতেন “তুই খা,আমি পরে খাবো,আমার অনেক আছে।”                           কত কত বার আমার চারখানা রুটি খাবার পরেও খিদে না মিটলে যখন রুটি চেয়ে বসতাম,জ্ঞ্যানহীন ছোট্টো আমি,তখন বাবা নিজের আধখানা রুটির একটুকড়ো টাও হাসি মুখে দিয়ে দিতেন খিদে নেই বলে।

জানেন আমাকে জন্ম দেবার পর ই নাকি মা মারা গেছেন প্রসব যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে।ভগবান যে কেন আমার মতো কুলাঙ্গারের জন্ম দিয়ে ভগবানের মতো মা টাকে মেরে দিলেন..তাহলে হয়তো এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।

তারপর থেকে এই ছোটো আমিকে ওই হতভাগ্য বাবা ই মানুষ করেছে। রাতে যখন অবুঝ আমি মাতৃদুগ্ধের জন্য কাঁদতাম,বাবা গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন।
বট গাছের মতো সারাক্ষন আচ্ছাদন হয়ে আটকে রাখতেন।চোখ থেকে জল পড়তে পড়তে নিজের ওপর ঘৃন্য চোখে বললাম-” না,না,মানুষ না,মালিক বাবু,মানুষ না,অমানুষ।অমানুষ তৈরী হয়েছি আমি। বাবার কোনো দোষ নেই।

হস্টেলে প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেন।না জানি কতো কষ্টের টাকা।আর আমি ওগুলো বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে এবং নেশা করে উরিয়ে দিয়েছি।বুঝিনি বাবা হবার কত যন্ত্রনা।আমার আরও কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।আরও কঠিন শাস্তি।”আমিতো বৃদ্ধালয় -এ ও থাকার যোগ্য নয়। জঙ্গলের পশুরাও আমাকে তাদের সাথে থাকতে দেবে না।”

মায়ের ইচ্ছা ছিলো আমি পড়াশোনা করে বড়ো একটা চাকড়ি পায়।হ্যাঁ,তারপর আমি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হলাম।বাবার কষ্ট,মায়ের কথা সব ই হয়তো রাখলাম। বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন শুনে।হয়তো বা মা ও।কিন্তু মানুষ হতে পারিনি।নিজের হাতে,যে হাতে বাবার হাত ধরে হাঁটতে শিখেছিলাম,সে হাতে বাবাকে এই বৃদ্ধালয় -এ ই রেখে গেছিলাম।বুঝিওনি,যে কতোটা পাপ করছি।

আমি সবে চাকরি পেয়েছি।বাবার তখন বয়স ভালোই হয়েছিলো।পরিশ্রম করে খেটে খাবার মতো আর ক্ষমতা ছিলোনা।তাই আমাকে ডেকে বললেন বাবার কিছু হবার আগেই বিয়ে করতে।আমি রাজি ও হলাম।বিয়ে ও হলো।তারপর ভালোই চলছিলো বেশ।

(ছবি- সংগৃহীত)

আস্তে আস্তে বয়স বাড়তে বাড়তে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিকল হয়ে পড়লো।ডাক্তার বললেন সবসময় সেবা করতে।অথচ আমাদের কারোর সময় হলো না যত্ন করার।আমি অফিস এ ব্যস্ত এবং স্ত্রী বাড়ির কাজ সামলাতে সামলাতে বাবার সেবা করে উঠতে পারছিলো না।তার ওপর ছেলের দেখাশোনা।

আমাদের ছেলের তখন দশ বছর বয়স।
আমাদের শত কষ্ট হলেও বাবা-মা কোনোদিন ছেড়ে যান না।অথচ দেখুন আমি যে সময়ে আগলে রাখার কথা,সে সময়ে ই বাড়ি থেকে বের করে বৃদ্ধালয় -এ পাঠিয়ে দিলাম।একবারের জন্যও মনে পড়েনি,এই বাবা ই একদিন কত কষ্ট করে আমার মুখে খাবার তুলে দিয়েছে এবং নিজে না খেয়ে,পড়ে আমাকে যত্ন করেছে।আর আজ সেই আমি ই এরকম পাপ কাজ করলাম।

 

কি করবো,আমি আর প্রতিদিনের অশান্তি মেনে নিতে পারছিলাম না।ছেলেটা দাদু অন্ত প্রান ছিলো।আর আমার স্ত্রী পছন্দ করতে পারতো না,যদি দাদুর সাথে মিশে কিছু রোগের সৃষ্টি হয়ে যায়।আমাকে বিরক্ত করে তুলেছিলো।আর আমি সব কিছু ভুলে বাবাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে এসেছিলাম। হ্যাঁ,ওই হাঁটতে শেখানো হাত গুলো দিয়েই টানতে টানতে বাবাকে এই বৃদ্ধালয় -এ রেখে গেছিলাম।

 

(ছবি- সংগৃহীত)

ছেলেটা তারপর কেমন যেন মনমরা হয়ে গেছিলো।কিছু খেতোনা। শুধু গুমরে গুমরে কাঁদতো।যে বাবা আমাকে জন্ম দিয়েছে,সে ছেলের এত টান নেই,যতোটা দাদুর জন্য নাতির টান আছে।আজ বুঝতে পারলাম যে বড়োদের দেখেই ছোটোরা শিক্ষা পায়।দাদু ও নাতিকে দেখার জন্য ছটপট করতো।তবু আমার সময় হয়নি কোনোদিন দেখতে আসার।আজ তার জন্য আফশোষ হয়।যদি ফিরিয়ে আনতাম একটিবার,তাহলে আজ এখানে বসে কাঁদতে হতো না।

(ছবি- সংগৃহীত)

পরে একদিন খবর পেলাম বাবা আর বেঁচে নেই।আমি প্রচন্ড ভেঙে পড়েছিলাম।এই বৃদ্ধালয় থেকে নিয়ে গিয়ে বাড়িতেও শেষবারের মতো যেতে পায়নি‌।যে বাড়ি কিনা তিনি তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন।জানেন, শ্মশানে চিতার চারিপাশে যখন জলন্ত আগুনের মশাল হাতে নিয়ে ঘুরছি,তখন বাবার মৃত শরীর থেকে যেন বাবা বলছে আমি শুনতে পাচ্ছি স্পষ্ট –

“আয়রে আমার পাশে আয় এখনি,
এ হাতটা ভাল করে ধর এখনি।
হারানো সেদিনে চল চলে যাই
ছোট্টবেলা তোর ফিরিয়ে আনি,
আয় খুকু আয়..।”
আমার চোখের জলটাও যেন পড়তে চাইনা।আকাশ এবং বাতাস যেন আমার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে।নদী যেন বলছে আমার ওপর  সজোরে আমার ওপর আঁছড়ে পড়বে।চিল ও শকুনি গুলো যেন আমাকে ছিঁড়ে খাবে বলে এদিকেই ধেয়ে আসছে।কেউ পাপীকে থাকতে দিতে চাইনা।কেউ না।


দাদুর মারা যাওয়ার শোকে ছেলে আমাদের দুজনের সাথে ভালো করে কথা বলতো না।খালি মেজাজ দেখাতো।না খেয়ে এককোনে পড়ে থাকতো।নিজের কাজে ও অব্দি যেতোনা।ছেলের ই বা কি দোষ,দাদুর আদর থেকে তো আমরাই বঞ্চিত করেছি।সবসময় প্রেসার দিয়ে তাকে ক্রমাগত জর্জরিত করে তুলেছিলাম।

ছেলে তখন বেশ বড়ো হয়েছে।ভাবলাম বিয়ে দিলে হয়তো সব ঠিক হবে। হ্যাঁ, সত্যি সব ঠিকই হয়েছে।না না,ছেলের বউয়ের কোনো দোষ নেই।ছেলে একদিন আমাদের ডাকলো এবং বললো,তোমাদের এখানে থাকার সময় তো এবার শেষ বাবা।দাদুও তোমাদের বিয়ে দেবার পর ই গেছিলেন বৃদ্ধালয়।তাহলে তো তোমাদের ও ওখানেই যাবার কথা।

(ছবি- সংগৃহীত)

আমি আঁতকে উঠলাম।বোঝাবার চেষ্টা কি করবো,আমি তখন বাকরূদ্ধ।হ্যাঁ, সত্যি তো আমাদের ওখানেই থাকার কথা‌।আমরা যা শিখিয়েছি তাই তো ছেলেও শিখবে।যদি আমরা বাবাকে বাড়িতে রাখতাম,তাহলে আজ এখানে বসে কাঁদতে হতো না।
ছেলে সুটকেস টা দিয়ে একই ভাবে  বৃদ্ধালয় -এর গেটের সামনে রেখে দিয়ে গেলো আমাদের।

(ছবি- সংগৃহীত)

মালিক বাবু আপনি অজান্তেই সেই বাবার ঘরটাই আমাদের থাকতে দিলেন দেখুন।বাবার সেই ছেঁড়া পাঞ্জাবিটা ঝোলানো রয়েছে এবং আলমারিতে পেন আর ডায়েরিটাও।ডায়েরি জুরে শুধু আমাদের নিয়ে লেখাই ভর্তি।খুব বলতে ইচ্ছে করছে,”বাবা তুমি আবার ফিরে এসো,দেখো আমাদের এত বড়ো বাড়িতে তোমার ঠাঁই হয়নি।অথচ তোমার এই বৃদ্ধালয় -এর ঘরে আমরা ঠাঁই পেয়েছি।আজ তোমার মতো আমাদের ও এক ই অবস্থা।
“আমাদের শেষ ঠিকানা আজ বৃদ্ধালয় -ই হয়েছে।”

(ছবি- সংগৃহীত)

আজ চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে ইচ্ছে করছে এবং বলতে ইচ্ছে করছে,বাবা আমি আমার পাপের শাস্তি পেয়েছি।অনেক অন্যায় করেছি।যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে,তাহলে আবার তুমিই আমার বাবা হয়ে ফিরে এসো কিন্তু।আমি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই বাবা।আমি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *