বিন্তি হয়তো এই সময়ের অপেক্ষায় ছিল

প্রচলিত সমাজে এমন এক সময় ছিল, যেখানে পরিবারের প্রতিটি মেয়েকেই পিঁজরাবদ্ধ করা হত বিভিন্ন অযৌক্তিক, গোঁড়া প্রবৃত্তির নিয়মাবলী দ্বারা। নিজস্ব স্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ‘বিন্তি’ তাদের মধ্যে একজন প্রতিটা পরিস্থিতি যার সাথে তুলনীয়। বয়স? ওই বছর আঠারো! সমাজটা যে এখনো গোঁড়া নেই সেটা বললে ভুল বলা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ এখনও নিজেদের ভাবধারায় বদল আনতে পারেনি। এবার আসি বিন্তির কথায়। যতবার সে নিজেকে স্বতন্ত্র, বন্ধনহীন হিসাবে খুঁজে পেতে চাইত, ততবারই নিজেকে খুঁজে পেত বাঁধাপ্রাপ্ত অবস্থায়।সৃষ্টিকর্তা হিসাবে তো বলা যায় ধর্মোন্মক্ত, গোঁড়ামিপূর্ণ সমাজ।

এরম বহু জায়গায় বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে তার স্বপ্নগুলো ভাঙতে দেখেছে বিন্তি। উদাহরণস্বরূপ অনেক ঘটনাই সামনে আসে। মেয়ে হিসাবে বাড়ি থেকে কিছু নিয়ম তার সামনে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। বিন্তি তখন ক্লাস নাইন। তার টিউশন শেষ হয় মঙ্গলবার রাত সাড়ে ন’টায়। ন’টা অতিক্রম করে যাওয়ায় তার বাড়ি থেকে বলা হল এই টিউশনে সে পড়তে পারবে না, কারণ ভদ্র বাড়ির মেয়েদের নাকি রাত পর্যন্ত বাইরে থাকাটা ভালো দেখায় না। তার সায়েন্সের টিউশন বন্ধ হয় আর পরিবর্তে বাড়িতে রাখা হয় প্রাইভেট টিচার। বিন্তির গায়ের রং একটু মাজা ধরণের, ভদ্র সমাজ যাকে শ্যামবর্ণা বলে।

আশপাশের পাড়া প্রতিবেশী থেকে শুরু করে বন্ধু বান্ধব সবাই সুন্দরী মানেই তো আবার ফর্সা মেয়েদের ব্যাখ্যা দেয়। বিন্তি বড়ো হওয়ার সাথে সাথেই আশপাশের গোঁড়া নিয়মাবলীর বিরুদ্ধে গলা হাঁকড়াতে শেখে তবে তাকে ফের দমিয়ে এটাই শেখানো হয় যে, মেয়েদের ব্যবহার সবসময় নম্র আর মার্জিত হওয়া উচিত সমাজের চোখে। বিন্তি শেখে, কোনো অপরাধ হতে দেখলেও তাকে তথা প্রতিটা মেয়েকে নিস্তব্দে কেবল দর্শকের মতোই দেখতে আর শুনতে হয়, কিছু বলার অনুমতিটুকু থাকে না । বেশি কিছু বলতে গেলেই নাকি মেয়েটি সমাজের কাছে বাচাল হিসাবে পরিণত হয় ।

মেয়েটি যদি কাউকে ভালোবাসে, তখন এটা প্রমাণিত হয় যে মেয়েটির চরিত্রে খাঁদ আছে কারণ ভদ্র এবং কনজার্ভেটিভ ফ্যামিলির মেয়েরা নাকি ‘প্রেম’ করে না। বিন্তির কত্থকের ফর্মটা বেশ লাগে। একদিন তার মায়ের কাছে ইচ্ছেটা প্রকাশ করবে ভাবতেই এতগুলো বাঁধা তার মাথায় আসে। সে নিজেকে সংযম করতে শেখে।

 

১৫ ই আগস্ট আসে, বিন্তি ছাদের দিকে ছুটে যায় সকাল পেরিয়ে বেলা আসতেই। লাটাইটা ছোটো ভাইকে ধরিয়ে তার পছন্দের ঘুড়িটা মাথার চুলে ঘষে ওড়াতে যাবে, ঠিক এমনসময় তার ঠাম্মি উপরে ছুটতে ছুটতে এসে বলেন “ঘুড়িটা ভাইকে দিয়ে নীচে আয় লুচি ভাজছি কয়েকটা আমায় বেলে দিবি…” আবারও সে আশাহত হয়ে নীচে নেমে যায়। যদি কোনো মেয়ের অধিক সংখ্যক বন্ধু থাকে, হ্যাঁ বন্ধুই তবে সে বাচাল।

এভাবে সে নিজেকে জড়ো করতে করতে বড়ো হয়ে ওঠে। অধিক সময় বাড়িতে বসে একা থেকেই কেটে যায় আর সারা বিকেলটা সে সেই খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। সেই খাঁচাটা? যেটায় ওদের ময়নাটা বদ্ধ ছিল এবং এরমই কোনো এক বিকালে বিন্তি বাড়ির লোকেদের অজান্তে ছাদে এসে ময়নাটাকে উড়িয়ে দেয়। তবে সেই খালি খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে ঘন্টা কাটানোর কি কোনো কারণ আছে? (দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে) আছে। উড়তে সেও চায়, মুক্ত হতে সেও চায় এসব কুসংস্কারগুলো থেকে।

সে নিজেকে নিশ্চুপ রাখতে চেষ্টা করে, কথোপকথন কমিয়ে দেয় কিন্তু খেয়াল কেউ করেনি। স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা প্রতিধ্বনি তাকে তাড়া করে বেড়ায় ” মেয়েদের হেঁশেলেই পরিবারের জন্য রান্না করতে ভালো দেখায়.. মেয়েদের নামের পাশে কোনো ডিগ্রি দরকার পড়ে না.. ঘরকন্যা হলেই চলে। তাও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে সে তার লক্ষ্যটাকে ধীরে ধীরে উজ্জ্বল করতে থাকে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক প্রতিটা স্তরের পরই তাকে শুনতে হয় “বিয়ে করে নে বিন্তি.. তোর সময়ে তো এক ছেলের মা হয়ে গেছি.. বড়ো সংসার সামলাতে হয়েছে”।

এটাও পড়তে পারেন: ফর্ম-এ-ধর্ম

প্রতিবারই গোঁড়ামিগুলোর মাঝে সে নিজেকে হাড়িয়ে ফেলে। সে নিশ্চুপ থাকে আর তার মা তার অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। উচ্চমাধ্যমিক উধরে বিন্তি ক্ল্যাটের এন্ট্রান্স ক্র্যাক করে, যেই জগতে তার স্বপ্ন লুকিয়ে ছিল। স্কোর ভালো আসায় চান্সও পায় সরকারি কলেজে।

আঠারো থেকেই ধীরে ধীরে নিজেকে গড়তে থাকে বিন্তি আর স্থির করতে থাকে এই কুসংস্কারগুলো দূর করতে হবে।

বছর ছয় বাদ রিনাউন্ড অ্যাডভোকেট হিসাবে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এখন সে কুসংস্কার মুক্ত। নিজে মুখ খুলতে পারে, প্রাপ্ত জবাবগুলো মুখের উপর বসিয়ে তবেই নিজের জায়গা ছাড়ে।

জীবনে চলার ক্ষেত্রে অনেক অপ্রয়োজনীয় রীতি নীতি আসেই। সেগুলোর সব মানাটা আবশ্যক নয়। কিছুর উত্তর তৎক্ষণাৎ দেওয়া গেলেও কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে হয় সময়ের, নিজের প্রতিষ্ঠার… বদলায় অনেক কিছু আর বিন্তি হয়তো এই সময়ের অপেক্ষায় ছিল।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *