জোড়া ইলিশ আঁশ মাহাত্ম্য

“জোড়া ইলিশ এসে গেছে গো , গিন্নি মায়েরা কে কোথায় আছো শিগগিরই আসো” চাকর দিনুর ডাকে হুলুস্থুল পরে গেলো মুখার্জি বাড়িতে । বরিশাল জেলার বিরমহল গ্রামের এক প্রান্তে বিশাল দালান বাড়ি তার সামনেই জোড়া পুকুর । সিংহ ফটক পেরিয়ে ঠাকুর দালানে প্রবেশ করার আগেই বা দিকে কাছারি ঘর, তার ঠিক পিছনে কুলদেবতার মন্দির । দেবী মনসার নিত্য পূজা হয় সেখানে।এক কালে জমিদারির রমরমা থাকলেও বর্তমানে সেই জৌলুশ আর নেই।কালের নিয়মে এসব অতীত তবুও বছরে দুবার পুরোনো এই জমিদার বাড়িতে হৈ হৈ কান্ড শুরু হয়।একবার মনোসপুজোর সময় আর একবার বাগদেবীর আরাধনার সময়। মাঘ মাসে শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে বেশ বড় করেই দেবী সরস্বতীর পুজোয় হয় মুখার্জি বাড়িতে। বাপ ঠাকুর্দার আমল থেকেই এই চল হয়ে আসছে।বাড়ির ছোটো থেকে বড়ো সারাবছর ধরে এই দুটো দিনের জন্যই অপেক্ষা করে থাকে।

বাঙাল বাড়ির সরস্বতী পুজো আর ইলিশ দুটোই যেনো সমার্থক। শুক্লা চতুর্থীর দিন বিকেলে বাজার থেকে জোড়া মাছ কিনে আনতে হয়। বাড়ির সাধবা বধূরা বরণ ডালা সাজিয়ে অপেক্ষা করে যুগল ইলিশের আগমনের। বরণ ডালায় থাকে নানা বিধ উপাচার। নতুন মাটির প্রদীপ যেটা এই পুজো উপলক্ষেই বানানো হয় আর থাকে কাঁচা হলুদ,পান, সুপারি, কাঠালি কলা, ধান ,দূর্বা, সিঁদুর মাখানো আমের পল্লব। শঙ্খ ধ্বনি আর উলু সহযোগে বরণ পর্ব শেষ হওয়ার পর নতুন একটি মঙ্গল কুলোর উপর ইলিশ দুটিকে রেখে গঙ্গাজল স্নাত আমের পল্লব দিয়ে স্নান করিয়ে গৃহে প্রবেশ করানো হয় । জমিদারি ঠাট বাট কালের গর্ভে তলিয়ে গেলেও পুজোর প্রতিটি আচার সাবেকিয়ানার সাথে পালন করে চলতো মুখার্জি পরিবার। জীবন যাপনে কিছুটা আধুনিকতা ও নতুনত্বের ছোঁয়া পড়তে শুরু করলেও প্রথাপালনে সেই প্রভাব কখনো পড়েনি।

সরস্বতী পুজোয় বাঙালদের প্রচলিত রীতির থেকে কিছু ব্যতিক্রমী নিয়ম আদিকাল থেকেই চালু ছিলো এই বাড়িতে। ইলিশের আগমনের দিন থেকে পুজোর ঘট ভাসানের দিন পর্যন্ত বাড়িতে আর অন্য কোনো আমিষ রান্না হয় না। পাঁচ পদের লোভনীয় ইলিশ থাকে দুই দিনের খাদ্য তালিকায়।
এই পুজোতেই যেন শুরু হযে যায় সারা বছরের ইলিশ ভোজের সূচনা।
যুগল মাছের গৃহ প্রবেশের পর সেই মাছ কাটতে বসেন বাড়ির কর্তারা। সারাবছর গিন্নিরা রান্না ঘরের কাজকর্ম দক্ষ হাতে সামাল দিলেও এই একটি দিন মাছ কাটার দায়িত্ব এসে পড়ে বাড়ির পুরুষ দের। তবে এটাও বিরমহলের মুখার্জি বাড়ির প্রথারই একটা অঙ্গ। পুজোর জন্য তোলা থাকে শান দেওয়া বটি। বাড়ির বড় কর্তা আর মেজ কর্তা স্নান করে সাদা ধুতি পরে তবেই মাছে হাত দেন।

এটাও পড়ুন: অরন্ধন বা রান্নাপুজো

জোড়া ইলিশ কাটার সময় সারা বাড়িতে যেন হটাৎ শোরগোল , প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। রান্না ঘরে দুই কর্তা কে ঘিরে গোল হয়ে জড়ো হয় বাড়ির সব সদস্য। প্রথমেই সযত্নে ইলিশের গা থেকে আঁশ ছাড়ানো হয়। তারপর বড় কাঁসার বাটিতে সেই আঁশ রাখা হয়। কে কটা আঁশ নিতে পারে এই নিয়ে মোটামুটি হুড়োহুড়ি লেগে যেত বাড়ির ছোটো দের মধ্যে। জোড়া ইলিশ এর এই আঁশ কে সুখ সমৃদ্ধি ধন সম্পদের প্রতীক রূপে দেখা হত। টাকা জমানোর সিন্দুকে, বাক্সে, থলিতে, ঘটে সর্বত্র মাছের আঁশও রাখা হত। এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিলো যে এই আঁশ রাখলে মা লক্ষী তুষ্ট হবেন অর্থাৎ সর্বদা সচ্ছলতা বিরাজ করবে এই সংসারে।
এর পরেই পাঁচ রকম পদের রান্না হত এই জোড়া ইলিশ দিয়ে। সরস্বতী পুজোর দিন দেবীকে ভোগ দেওয়া হবে মস্তক পোলাও দিয়ে। অর্থাৎ পোলাও তে ইলিশের মাথা থাকা আবশ্যক। পুজোর আগের দিন থেকে বিসর্জনের দিন অবধি বাড়ি থাকত ইলিশময়।এই মাছ নিয়ে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন নিয়ম প্রচলিত আছে। তবে রীতি ও ঐতিহ্য ভেদে কোনো কোনো বনেদী বাড়িতে তার ব্যতিক্রম ও আছে বই কি। তবুও সরস্বতী পুজো মানেই ঘরে আগমন ঘটবে জোড়া ইলিশের। সেই ইলিশকে ঘিরে চলত সকলের মধ্যে নানা ব্যস্ততা ,নতুন নতুন পদ তৈরির প্রতিযোগিতা। কোন বাড়ি কোন নতুন পদ রেঁধে তাক লাগিয়ে দিলো সেটা নিয়ে গ্রামে বেশ চর্চার বিষয় হয়ে ওঠত।পূর্ববঙ্গের সেকেলে বয়োজ্যেষ্ঠ অনেক মানুষের কাছেই এই ইলিশের গল্প শোনা যায়। আমার পরিবারের কিছু বংশধর পূর্ব বঙ্গে থাকার সুবাদে তাদের কাছেই এই কাহিনী শোনা। শুধু সেকালে নয় একালেও বহু বাঙাল বাড়িতে আজ ও এই প্রথা পালিত হয়ে আসছে।আধুনিক কালে যৌথ পরিবার ভেঙে হয়েছে একক পরিবার তাই পূর্বের সমস্ত আচার রীতি মেনে পুজো করতে না পারলেও শুধু নিয়ম রক্ষার্থে অনেক ঘরেই শ্রী পঞ্চমীর সরস্বতী পুজোর দিন ইলিশমাছ রান্না হয়।

 

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *