“অন্তহীন” আসলে ফুরিয়ে না যাওয়া ভালবাসার কথা বলে… যে অপেক্ষার কোনো শেষ নেই সেই গল্প বলে। অন্তহীন বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটা মাইলস্টোন যেটা ২০০৯ সালে বাঙালিকে নতুন করে আরেকবার ভাবিয়ে তুলেছিল। আজ থেকে একযুগ আগে এই সিনেমা মুক্তি পায়। লেখালিখিও হয়, সমালোচক এবং দর্শকদের থেকে যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছে সিনেমাটি।
বাঙালি সিনেপ্রেমিকদের কাছে এই সিনেমা নিয়ে নতুন করে সত্যিই বোধহয় কিছু বলার নেই। তাও এতবছর পরে আমি এই সিনেমাটি নিয়ে লেখার কথা ভাবলাম কারণ আমার পছন্দের সিনেমার তালিকা দীর্ঘ হলেও, এই “অন্তহীন” সিনেমাটির জন্য আমার মনে একটা অন্য জায়গা রয়েছে। খুব মনখারাপের দিনেও কিভাবে যেন এই সিনেমা আমার মনকে ঠিক করার ক্ষমতা রাখে। গত ১২ বছরে বহুবার এই সিনেমা আমি দেখেছি এবং প্রত্যেকবার নতুন কিছু মেসেজ খুঁজে পেয়েছি। এই কাহিনীর শেষ অংশ হয়তো অনেকের চোখেই এক পশলা বৃষ্টি নামায়। তবু এটা দেখার পরে মনটা খুব শান্ত হয়ে আসে, “স্নিগ্ধ” লাগে।

জীবন আসলে ভীষণ ক্ষণস্থায়ী। এইটুকু সময়ের ভিতরেই কত ঘটনা, কত অনুভূতি লুকিয়ে থাকে। বৃন্দা-অভিকের ভার্চুয়াল রিলেশন এবং রিয়েল লাইফ আমাদের কাছে ভীষণভাবে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। শহুরে কর্মব্যস্ত জীবনের আধুনিকতার মাঝেও ভালবাসা, অপেক্ষা, অনুভূতির গভীরতা ছড়িয়ে থাকে সেই চিত্রই নিপুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী। রঞ্জন এবং পারমিতার গভীর জীবনবোধ আমাদের মুগ্ধ করে। অভিমান, দূরত্ব, একাকিত্ব, সম্পর্ক নিয়ে এদের মুখ থেকে যে সংলাপগুলো বলতে শোনা যায় সেগুলো আমাদের নিজেদের জীবন নিয়েও ভাবতে সাহায্য করে। পিসিমার মুখে তাঁর নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য আসলে তাঁর শিক্ষা এবং স্বাধীনচেতা মনোভাবের পরিচয় দেয়। কিছু কথোপকথন গতানুগতিক চিন্তাধারা এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শেখায়। কেউ একা থাকতে চায় মানে সে নিজেকে বঞ্চিত করছে অন্যের জন্য কিংবা সে আফসোস করে, দুঃখে আছে এমনটা নয়। কেউ নিজের ইচ্ছেতে, নিজের খুশিতে তার জীবনের রাস্তা বেছে নিতে পারে। চরিত্রগুলির বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা, কাজকর্ম, ঝকঝকে উপস্থাপনা এবং সাজপোশাকের রুচিশীলতা দর্শকের মনকে সম্মোহিত করে। শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন, কল্যাণ রায়, রাহুল বোস, রাধিকা আপ্টে এদের সকলের অভিনয় মন ছুঁয়ে যায়।

এই সিনেমার দৃশ্যগুলোর সাথে গানগুলোকে এমনভাবে বোনা হয়েছে যার পরতে পরতে মায়া জড়িয়ে থাকে। শান্তনু মৈত্রের সুরে, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় এবং চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের কথায় গানগুলো আমাদের মনকে আবিষ্ট করে রেখেছে এক যুগ ধরে। সুখে দুঃখে এই গানগুলো আমাদের অনেকের সঙ্গী হয়ে থাকবে আজীবন। “আমার রাতজাগা তারা” গানটির বিভিন্ন লাইন যেমন “তুমি মায়ের মতোই ভালো… ” কিংবা “প্লিজ ঘুম হয়ে যাও চোখে আমার মনখারাপের রাতে” অথবা “আমি পাইনা ছুঁতে তোমায়, আমার একলা লাগে ভারী” এগুলো বাংলা সিনেমার গানের ইতিহাসেও এক অন্য হাওয়া এনে দিয়েছিলো। স্বনামধন্য শিল্পীদের কণ্ঠের জাদুতে “যাও পাখি বলো”, “ফেরারী মন”, “মুঠো রুমাল” প্রভৃতি গানগুলি শ্রোতাদের মধ্যে মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে দেয়। এই জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত সিনেমাটি আমাদের এক অদ্ভুত মনকেমনের এবং ভালো লাগার অনুভূতি দেয় সবসময়।