রক্তের দাম

“এরা শুধু বাচ্চা জন্ম দিয়েই খালাস, তারপর এদের আর কোন দায়িত্ব থাকেনা”, হাতের ফাইলটা এক প্রকার টেবিলে ছুঁড়ে দিয়ে সিনিয়র রেসিডেন্ট রাজীবদা এক রাশ বিরক্তি প্রকাশ করলো। সাব্বির জানে রাজীবদা কার কথা বলছে।

১৩ নং বেডে থ্যালাসেমিয়ার বাচ্চাটা আজ সকালেই এসেছে । হিমোগ্লোবিন পাঁচের নীচে। এক্ষুনি ব্লাড দেওয়া প্রয়োজন। বাচ্চাটা ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছে মায়ের কোলে। এই গরমের মরসুমে ব্লাডব্যাংক শূন্য। থ্যালাসেমিয়া হোক বা যে কোনো ক্রিটিকাল ট্রমা পেশেন্ট, চোখের সামনে রক্তের অভাবে মরতে দেখাই যেন এক প্রকার ভবিতব্য।
এমতাবস্থায় রাজীবদা পেশেন্ট পার্টিকে বলেছিল তারা যদি ডোনার জোগাড় করতে পারে তাহলে একটা উপায় হয়।বাচ্চার বাবার ব্লাড গ্রুপ এক হলেও সে তার মৃতপ্রায় মেয়ের জন্য রক্ত দিতে নারাজ, একথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। সেই কারনেই রাজীবদার এই আস্ফালন।

ফাইনাল ইয়ার পাশ করে সদ্য ইন্টার্নশিপ জয়েন করা সাব্বির উশখুশ করছিল কিছু একটা বলবে বলে,এবার সাহস করে বলে ফেলে, “ওর ফাইলটা আমি দেখেছি, আমারও একই ব্লাড গ্রুপ, তুমি বললে আমি ব্লাড দিতে পারি রাজীবদা, তুমি বাচ্চার মা কে জানিয়ে দাও।”

– “তোর তো এখন রোজা চলছে, উপোস থেকে ব্লাড দিবি কি করে?” পাশ থেকে ফস করে বলে বসে বিতানু, সাব্বিরের রুমমেট ও কো-ইন্টার্ন।
– “আজ না হয় আগেই রোজা ভাঙবো, সে তুই আমার উপর ছেড়ে দে।”

রাজীবদা মতো রাশভারী সিনিয়র এর ঠোঁটের কোণেও এক ফালি প্রশ্রয়ের হাসি খেলে গেল। মেয়েটির মা এই প্রস্তাবে হাতে চাঁদ পেয়েছিল। “ডাক্তার বাবু আপনি ভগবান” বলে পা জড়িয়ে ধরেছিল সাব্বিরের। রক্তদান করে তাকে পরবর্তী কি করণীয় তা বুঝিয়ে দিয়ে তড়িঘড়ি আবার ডিউটিতে ফিরছিল সে, রক্তদান পরবর্তী সামান্য বিশ্রাম নেওয়ারও সময় হয়নি তার… দ্রুত পা চালিয়ে pediatric ওয়ার্ডের সামনে পৌঁছে অবাক হয়, সেখানে তখন পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ, চারিদিকে জনারণ্য, প্রত্যেকের হাতে বাঁশ, লাঠি, ইত্যাদি।গোলমাল আঁচ করে ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে যাবে, তখনই তার apron আর stethoscope দেখে ভীড়ের মধ্যে থেকে একটা আধলা ইঁট ধেয়ে আসে সব্বিরের মাথা লক্ষ করে।চোখের সামনেটা অন্ধকার নেমে আসার আগের মূহুর্তে সে শুনতে পায় অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ। জনৈক রোগী মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ডাক্তাররা তখন পেশেন্ট পার্টির হাতে আক্রান্ত। অতএব ভগবান ভূপতিত হলো…

ইন্টারন্যাল হেমারেজ এর তিন দিন পর ঝরে পড়ে এক তরুণ তরতাজা চিকিৎসকের প্রাণ। সাব্বিরের জানা হয়নি বাচ্চা মেয়েটা সে যাত্রায় তার রক্তে প্রাণে বেঁচে গেছে, জানা হয়নি তার জন্য দশ ইউনিট রক্ত জোগাড় করেও তার সহকর্মীরা প্রাণপাত করেছে কারন রক্তের জন্য হাহাকার শেষ হয়নি। তার রক্তের দাম সে পেয়েছে প্রতিবাদ মিছিলে আর সোশ্যাল মিডিয়া হ্যাশট্যাগে। তার ‘খুনি’ রা আজও ধরা পড়েনি…।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *