কিছুটা অবৈধ

বৈধ ও অবৈধের মাঝের সূক্ষ্ম সীমারেখার নাম মান্যতা। সমাজ মান্যতা দিলে বৈধ, আর না দিলেই সেটা তকমা পায় অবৈধ। আসলে এই বিষয়টি খুব আপেক্ষিক। প্রাচীনকালে যেটা বৈধ বলে বিবেচিত হতো এখন সেটা অবৈধ কিংবা তখন যা অবৈধ ছিল এখন বর্তমানে সেটাই বৈধ। যদি সামান্য এক-দেড়শো বছর আগেই দেখি তাহলেও দেখবো পুরুষের একাধিক বিবাহ বৈধতা পেত কিন্তু বর্তমানে তা অবৈধ। সেই সময় বিধবা বিবাহ তো দূরের কথা বরং সহমরণ প্রথা প্রচলিত ছিল, একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিধবা বিবাহ অনেকটাই সাবলীল— এক্ষেত্রেও বৈধ-আবৈধের সংজ্ঞা বদলেছে। তবুও সমাজের কটাক্ষ, তির্যক চাহুনি রয়েই গেছে। যাই হোক, অবৈধ শব্দটি যে পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে বেশি এসে পড়ে সেটি হল সম্পর্ক। হ্যাঁ, আমরা যে সম্পর্কের নামকরণ করতে পারি না, তারই নাম দিই অবৈধ সম্পর্ক।

আমাদের জীবনে এমন কিছু সম্পর্ক থাকে যা কোনো নামের গণ্ডিতে বাঁধা যায় না। অনুভূতি গুলো এতোই জটিল থেকে জটিলতর হয় যে তাকে বিশ্লেষণও করা যায় না। এমনই একটি সম্পর্ক রয়েছে নয়না ও অঞ্জনের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে দুজনেরই সবিস্তার পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। আবার এই পরিচয় পর্ব ধরেই চলে আসে রাতুলের কথা।

বছর দশ আগে ফেরা যাক— বাপ-মা মরা নয়না পিসির বাড়ি বেশ আদর যত্নেই থাকতো। পিসি, পিসো আর রিয়ান। রিয়ান নয়নার পিসির ছেলে, এগারো বারো বছরের ভাইটা ছিল বড্ড দিদি ঘেঁষা। নয়না উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো নম্বর পেয়ে সুন্দরবন থেকে কলকাতায় এসেছিল ভালো কলেজে পড়াশোনা করতে। আর সেখানেই তার রাতুলের সঙ্গে প্রথম দেখা। ডাকাবুকো রাতুল কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের অন্যতম সদস্য। যেকোনো সমস্যা নিয়ে ওর কাছে পৌঁছতে পারলেই মোটামুটি সমাধান হয়ে যায়। রাতুলের তখন কেমিস্ট্রি ফাইনাল ইয়ার। সবাই খুব অবাক হয়, রাতুল ইউনিয়নে সারাদিন পড়ে থেকেও পড়াশোনা কখন করে, এতো ভালো রেজাল্টই বা কী করে হয়! এবার আসল কথায় ফেরা যাক। নয়না কলেজে ভর্তির সময় একটি রিসিভ কপি দেখাতে পারেনি, সেই কারণে ওর ভর্তি আটকে গিয়েছিল। একবুক স্বপ্ন নিয়ে কলকাতায় আশা মেয়েটা একেবারে ভেঙে পড়েছিল। পিসোর কোলে মাথা রেখে সশব্দে কেঁদে যাচ্ছিল। হঠাৎ এই দৃশ্য দেখে রাতুল তো হেসেই কুটোকুটি। মেয়েটা কান্না থামিয়ে রণমূর্তি ধরে সে কি বাক্য বাণটাই না ছুঁড়েছিল! কি জানি সেই বাক্য বাণই বুঝি রাতুলের বুকে প্রেমের ক্ষত তৈরি করেছিল। সেটা যদিও নয়না অনেক পরে বুঝতে পেরেছিল রাতুলের হাবে ভাবে। নয়নার কলেজে ভর্তি থেকে শুরু করে হোস্টেলে থাকার সব ব্যবস্থাই করেছিল রাতুল।

কিছুটা কৃতজ্ঞতা ও কিছুটা ভালোলাগা নিয়ে নয়না রাতুলের কাছে ধরা দিয়েছিল। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা। ছোটবেলায় বাবা মা হারানোর দুঃখ ভুলতে পিসি, পিসোর পর রাতুলই নয়নার অবলম্বন হয়েছিল। কিন্তু সব সুখ কি সবার কপালে সয়! নয়না তখন কলকাতার হোস্টেলে। প্রকৃতি যেন ফুঁসছে, সাত-আট দিন ধরে টানা বৃষ্টি। নিম্নচাপ। সুন্দরবনে অনেক আগেই সাবধান বার্তা দেওয়া হয়েছে। সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। উদ্বিগ্ন নয়না তিনদিন পর যখন সুন্দরবন পৌঁছল, তখন সব শেষ। ছোটো থেকে যাদেরকে আঁকড়ে মেয়েটা বেঁচেছিল তারাই আজ নিশ্চিহ্ন প্রকৃতির দাপটে, কপালের দোষে।

বিধ্বস্ত অবস্থায় নয়না যখন আবার কলকাতায় ফিরে এলো, তখন একমাত্র ভরসা রাতুল। কোনোকিছু ভূত ভবিষ্যৎ না ভেবেই রাতুল সেদিন নয়নাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিল, আবার একটা নতুন পরিবার দিয়েছিল। নয়নাকে নিয়ে রাতুল যখন বাড়ি ঢুকেছিল সেই দৃশ্যটা বড়ই অদ্ভুত। বউয়ের পরনে ন্যাতা কাঁথা একটা সুতির চুড়িদার, এলোমেলো চুল বেনী আকারে পিঠে পড়ে রয়েছে। মুখে অনন্ত দুঃখ অথচ কীসের এক পরম তৃপ্তি। রাতুলের বাবা-মা মেয়েটাকে ফেলতে পারেননি। সন্তান স্নেহে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। আজও এই সন্তানটিই তাঁদের সকল সন্তাপ হরণ করে চলেছে। সেও এক ভাগ্যের পরিহাস।

রাতুলের বাবা মা নয়নাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতো, এখনও বাসে। তিনটে বছর দেখতে দেখতে কেটে গেল। সে বছর নয়না কলেজ টপার। রাতুলেরও এম.এস.সি কমপ্লিট। রাতুলও যে দুর্দান্ত রেজাল্ট করবে সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। খুশির দুটি কারণ যখন এক হয়ে যায় তখন তো উদযাপন করতেই হয়। দীনেশ বাবু মানে রাতুলের বাবা একটি ছোটখাটো আউটিং এর প্ল্যান করেন। এখানে একটু ভুল বলা হল, বিয়ের পর থেকে তিনি রাতুলের কম নয়নার বাবা বেশি। রসিক দীনেশ বাবু ফুলদানি থেকে একটি কাগজের ফুল নিয়ে মীনা দেবীকে প্রেম নিবেদন করে বললেন, “চলো গিন্নি, ওদের সাথে সাথে আমরাও মধুচন্দ্রিমাটা আরেকবার ঝালিয়ে আসি!” ছেলে-বৌমার সামনে একথা শুনে উনিও যেন খানিক লজ্জা পেলেন। রাতুল নয়না তো হেসেই বাড়ি মাথায় করলো। সেন বাড়িতে যেন আনন্দের ঢেউ খেলে গেল।

ক্রমশ…

–অর্যমা

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *