অলিগলি

কথায় বলে – বর্ণচোরা আম। আমার তো খালি মনে হয় বাড়ির ঘড়িগুলো এমনই একখানা করে জিনিস। কাঁটা দুটো হাবভাবে ওরকম গোবেচারা নিরীহ গোছের হলে কি হবে, ওদের মতিগতি বোঝা বড়ো দায়। এই যেমন রোববার হয়তো বিকেল পাঁচটায় কোথাও ঘুরতে যাওয়া আছে। প্রিয় মানুষটাকেও বলে রেখেছ সে যেন তোমার প্রথম মাইনের টাকায় কেনা নীলচে সালোয়ারটা পরেই আসে। আর দুপুরে ভাতঘুম না দিয়ে তুমিও নিশ্চয়ই প্রচন্ড উত্তেজনায় ঘরময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছ। কিন্তু দেওয়ালের নধর ঘড়িটার এতে ছিঁটেফোঁটা আগ্রহ নেই। সে তখন তার নিজস্ব গদাইলস্করি চালে এগোচ্ছে। পারলে এক মিনিটে এক ঘন্টার সময়টাকে সে পুষিয়ে নিতে চায়। অন্যদিকে তুমি প্রতি মুহূর্তে যতবার করে ঘড়ি দেখছ, বোধহয় সারাদিনে ততবার চোখের পাতাও পড়েনি!

কিংবা আজ হয়তো সোমবার। ছোটোবেলার বইপোকা বন্ধু অমিত বারবার বলেছে বেলা এগারোটার মধ্যেই কলেজ স্ট্রিটে চলে আসতে। রাস্তার অমুক মোড় থেকে সোজা পশ্চিমে হেঁটে গিয়ে তমুক কেজি দরের খাতার দোকানটাকে বাঁয়ে রেখে উল্টোদিকে তাকাতে হবে। সেখানে পড়ন্ত রোদের আলোয় সুবেশ  নামধারী এক বইব্যাপারী দাদার স্টলে বিশেষ অফার চলছে। কোন প্রকাশনীর বইতে কত ছাড় তাও তার ঠোঁটস্থ। আজকেই শেষদিন, ফোন করে সে জেনেছে স্টক শেষের দিকে। সময়মতো না পৌঁছলে নাকি ব্যানারসুদ্ধ দোকান সাফ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আর এসব শুনে তুমিও অফিস থেকে যেন তেন প্রকারেণ ছুটি ম্যানেজ করেছ।

বাবা অবশ্য বলেছেন, অফিস কামাই করছ যখন, সকালের বাজারটা কিন্তু করে দিয়ে যেয়ো। ইলেকট্রিকের ভুটাইকেও একবার খবর পাঠাও। টিভির পিছনের সুইচবোর্ডটা বিগড়েছে। একটাও ম্যাচ মিস করতে চাই না। মা বলেছেন, পারলে নিউ মার্কেটে একবারটি যাস তো। তুলির গেল বছরের জন্মদিনের উপহারটা এখনও বাকি আছে। ও বেচারি কি ভাববে বলতো।

তুমি তিরিশ সেকেন্ড মাথা চুলকে অবশেষে স্থির করেছ যে হাতের কাজগুলো সেরেই না হয় বেরোব। পূবালীর কলেজের পর ওকেও ফিরতি পথে ডেকে নেওয়া যেতে পারে। এক সপ্তাহ সামনাসামনি দেখা হয়নি ওর সাথে।

মুশকিলটা হল আগের দিন ঘুমোতে ঘুমোতে তোমার বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। এবার আসে বিছানা লাগোয়া টেবিলের সেই গুণধর অ্যালার্ম ঘড়ি। যার শত ডাকাডাকিতেও তোমার নিদ্রার গভীরতা অটুট থাকে বইকি। তাড়াহুড়োর দিনগুলোতেই সে বাছাধন জমিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে। কেননা, আটটা বাজতে না বাজতেই তার কাঁটাজোড়া আলোর বেগে ছুটতে শুরু করেছে।

ট্রেনের টাইম ছিল পৌনে দশটায়। কোনোমতে রুটিটুকু গিলে পাড়ার মোড়ে স্টেশনের অটোর জন্য দাঁড়িয়ে পড়তেই নজর গেল রিস্টওয়াচের দিকে। দশটা বেজে সতেরো। উফ! সময়টা খামোকা এত তাড়াতাড়ি এগোয় কেন! ইতিমধ্যে দুটো ট্রেন ফেল। পরের ডাউনটা সাড়ে দশটায়। এটা না পেলে অমিত আর আস্ত রাখবে না। বাজারে দেখা হলেই সর্বসমক্ষে চোদ্দবুড়ি কথা শুনিয়ে দেবে। রাজুদা হাসতে হাসতে খদ্দেরকে দুশো গ্রাম আলু বেশি দিয়ে ফেলবে। সুফল মিষ্টান্ন ভান্ডারের সুজয় মারাত্বক চমকে গিয়ে জলভরার ভারি ট্রে-টাকে জিলিপির তেলে ফেলতে ফেলতে সামলে নেবে। দেবেশবাবুর আঙুলের ফাঁক থেকে মুদিখানার বিশাল ফর্দটা বাজারের বিখ্যাত নয়ানজুলিতে প্রবেশ করবে।

হঠাৎ সেলিব্রিটির কায়দায় অটোর উদয়! চেপেচুপে বসার জায়গাও হয়ে গেল। স্টেশনে পৌঁছেই প্ল্যাটফর্মের দিকে সোনার মেডেলের দৌড় দিলে তুমি। ঝুলন্ত ডিজিটাল ঘড়ির লাল অক্ষরে তখন দশটা তেত্রিশ। ভাগ্য এ পর্যন্ত তোমার সহায়। হাপরের মতন হাঁপাতে হাঁপাতে ঝালমুড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলে, “দাদা গাড়িটা একটু লেট আছে তো? এখনও আসেনি তো?”

লোকটি পান-খাওয়া মুখে বললে, “হ্যাঁ তা আছে। দেখুন না তিন নাম্বারে কত ভিড়।”

“যাক বাবা…” তুমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে গিয়েও থমকে গেলে, “আরে না না। ওটা তো আপের লাইন।”

“অ। ডাউন বলছেন? সে রয়েছে অনেক। পেয়ে যাবেন।”

“দুত্তোর! বলছি যে এক্ষুণি একটা হাওড়া লোকাল ছিল…”

“সে আবার কাল আসবে।” লোকটা মুড়ি মাখায় মন দিল।

“মা-মানে?”

“আরে মশাই, দশটা পঁচিশে বেরিয়ে গেছে। এত তাড়া যখন লেট করেন কেন?”

তুমি পুরো থ! খানিক আগে পেটপুরে খেয়ে আসা মায়ের হাতের আলুচচ্চড়ির ঢেঁকুর ছাড়া কেউ তোমাকে সান্ত্বনা দেবে না তখন।

সবই সময়ের খেল! সে ব্যাটা চিরকাল স্বস্থানে একগুঁয়ের মতো অনড়। কারোর জন্য থেমে থাকে না। বসে বসে সকলের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আমার দাদামশায় ভারী চমৎকার দুটি লাইন বলতেন – সময়ের সাথে চলতে চলতে কেউই সময়ের মতো হতে পারলাম না রে। অমন বেপরোয়া হতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত আমাদের।

আমি ছাই অতশত মানে বুঝতাম নাকি! তবে শুনতে বেশ লাগত। দাদামশায় প্রায়ই ওরকম কথা বলতেন। এক সময় জাঁদরেল প্রোফেসর ছিলেন। দীর্ঘ তিরিশ বছর! বাতের ব্যথা নিয়েও রোজ বিকেলে আমাকে পড়াতে আসতেন। দাদুর সাথে খানিক খোশগপ্পো করে, চায়ের কাপসমেত প্লেটটা বামহাতে বসিয়ে ডানহাতে পাতা ওল্টাতেন কোলের ওপর রাখা ব্যাকরণের নোটসের ঢাউস খাতাটার। আর চা-টা শেষ হওয়া অবধি ভেবে নিতেন গতদিনের পড়া থেকে কি কি জিজ্ঞেস করা যায়।

একটা খুবই আশ্চর্য ব্যাপার ঘটত। দাদামশায়ের সামনে আমি সব প্রশ্নের একেবারে নির্ভুল জবাব দিতাম। অথচ পরীক্ষার হলে অবিকল সেই উত্তরটাই অন্য আরেকটার ঘাড়ে চাপিয়ে জগাখিচুড়ি করে আসতাম।

দুই দাদুর কাউকেই কখনও রাগতে দেখিনি। রেজাল্ট এলে অন্তত এই মানুষদুটোর কাছে কোনোদিন বকুনি জোটেনি। শুধু বলতেন, “নার্ভটা ঠান্ডা রাখতে শেখ বাবা। পারলে জীবনে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলবি।”

আমার কানের গহ্বরে এখনও কথাগুলো বৃষ্টির রিমঝিম ধারার সুরে বেজে বেজে ওঠে। মনে হয় এই যেন সেদিন বলেছিলেন। তারপর কোথায় যেন চলে গেলেন। অন্ধকারের কোন অলিগলিতে প্রবেশ করতে করতে আর মুখ ফিরিয়ে আমাদের দিকে চাইলেনও না।

কান্না পেলেই আমার ভিজতে বড়ো ইচ্ছে করে। ঠান্ডা লেগে যাবে লেগে যাবে করে আমার আর বৃষ্টির মাঝে কবে একখানা প্রাচীর উঠে দাঁড়িয়েছে। ইমিউনিটি বাড়াতে কখনও-সখনও হলুদ মেশানো গরম জলও খাই। বৃষ্টি থেমে গেলে মনে হয়, এই যাঃ! আজও ভেজা হল না। অবশ্য পূবালী সঙ্গে থাকলে অন্য ব্যাপার। সে মুহূ্র্তে আমি আমাতে সচরাচর থাকি না। ও কিন্তু ভিজতে খুব পছন্দ করে। যত গন্ডগোল পাকাই আমি। আমার কেমন বদখত অভ্যেস, মেঘলা আকাশ দেখলেই ছাতাটা বগলদাবা করে ফেলি। পূবালী তখন চোখ পাকিয়ে ছাতা কেড়ে নেয়। আমি নিঃশব্দে হাসি। সব হাসির সৌন্দর্য্য শব্দে প্রকাশ পায় না। ও বলে, তুমি একটা বাতিকবুড়ো।

কিছু কিছু বাতিক থাকা বড্ড সুখের। কারণ ভিজতে গেলেই আমি ঠিক জানি, প্রথমে দারুণ নাক সুড়সুড় করবে, তারপর খোলা রাস্তায় শুধু আমি আর হাঁচি। কমপক্ষে আট-দশটা রাউন্ডের আগে খেলা থামার প্রশ্নই নেই। পূবালী সুতির ওড়না দিয়ে আমার মাথাটা মোছাতে মোছাতে অস্থির হয়ে উঠবে। তারপর ওর সবচেয়ে মিষ্টি গলায় বলবে, তোমায় নিয়ে আর পারি না।

এই হাঁচি নিয়েই আমার অনেক পাঁচমেশালি স্মৃতি আছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব।

ক্রমশ…

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *