শেষ

সবকিছুরই একটা শেষ থাকে।
এই শেষ থাকাটা খুব দরকার।
তা সে শৈশব হোক, বা কৈশোর; শীত হোক, বা গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত…
শেষ হওয়াটা জরুরি।
নইলে জীবন কেমন যেন বিতৃষ্ণায় ভরে যেত।
বসন্তের কথা নয় ছেড়েই দিলাম কারণ—
আমার জীবনে বসন্তটা বরাবরই গুরুত্বহীন।
বসন্তটা আমাকে তেমন ছুঁয়ে যায় না কোনোকালেই,
পালিয়ে বেড়াই বলেই হয়তো সে নাগাল পায় না আমার।
তাকেই বা দোষ দিই কীকরে?

আসলে বসন্ত বলে যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে—
তবে আমার জীবনে তা ঐ পরীক্ষা পরীক্ষা হাওয়া মাত্র।
যে হাওয়া গায়ে লাগলেই ভয় করে;
সিলেবাসের বাইরের প্রশ্ন আসার ভয়, হঠাৎই সময় শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়,
কখনও আবার চাওয়ার চেয়ে কম নম্বর পাওয়ার ভয়,
আর সর্বোপরি হেরে যাওয়ার ভয়।
সে যাই হোক, যেহেতু কথা হচ্ছিল শেষ নিয়ে—
তাই বসন্ত আর ভয় নিয়ে এই অযথা চর্চার কোনও অর্থই হয় না।
গল্প হোক শেষ নিয়েই!

শেষ শব্দটা উচ্চারণ করা যত সহজ, একে সহ্য করা ঠিক ততটাই কঠিন;
ততটাই কঠিন একে পেরিয়ে যাওয়া, এর পরেও ভালো থাকতে পারা।
আসলে আমরা যারা পরিস্থিতির চাপে কখনও না কখনও নিজেদের প্রিয় গল্পগুলোর শেষ ঘোষণা করতে বাধ্য হই, তারাই আবার সেই গল্পগুলোর রেশ নিজেদের অন্তরাত্মায় জিইয়ে রেখে ঘুরে বেড়াই প্রতিনিয়ত।
গল্পগুলো অনেকটা ওই রবিঠাকুরের ছোটগল্পের মতোই শেষ হয়েও যেন শেষ হতে চায় না আমাদের জীবনে।
আর তাই উপন্যাস লেখার মতো দক্ষ লেখক আর হয়ে ওঠা হয় না আমাদের।

সম্পর্ক হারানোর ভয়ে আমরা যারা পালিয়ে বেড়াই রোজ, সেই সম্পর্কেরাই আমাদের হারিয়ে পালিয়ে যায় একটা সময়।
শুধু অপেক্ষায় রয়ে যাই আমরা, আক্ষেপে বাঁচি আমরা।
আমরা সেই সম্পর্কগুলোর জন্য হাপিত্যশ করে করে হাজার খানেক নতুন সম্পর্ককে নাকোচ করে ফেলি শুধুমাত্র শেষ শব্দটাকে মানতে পারি না বলে।
মানিয়ে নিতে না পারা, বা মেনে নিতে বাধ্য হওয়া এই প্রতিটা শেষের পরই আমরা নিজেদের পরিচিত গন্ডীর এক কোণে গিয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিই।
আমাদের অভ্যাসগুলো ক্রমশ ক্ষয়ে যেতে শুরু করে,
ঘুন ধরে আমাদের বেশিরভাগ অনুভূতিতে।

অভাব-অভিযোগ সমস্তটাই মনবন্দি করে নিই আমরা।
ওয়েবসাইটে লগ ইন করার জন্য ঠিক মতো ক্যাপচা টাইপ করা ছাড়া, আর কোন বিষয়েই নিজেদের অযান্ত্রিকতার প্রমাণ দিতে ইচ্ছে করে না একটা সময়।
যারা ছেড়ে যায় তারা আর ফিরে তাকায় না আমাদের স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দু’চোখের দিকে,
তারা ফিরে আসে না আমাদের অভ্যাসে বা রোজনামচায়, খোঁজ রাখে না আমাদের বদলের।
শুধু আমরাই বদলাতে বাধ্য হই, বাধ্য হই নিজেদের অস্তিত্বটুকু অস্বীকার করে এগিয়ে যেতে।
আমরাই শুধু নিয়ম ভাঙ্গার অভ্যাস রপ্ত করি, গুচ্ছের অভিযোগ অস্বীকার করার চেষ্টায় দিনরাত লড়াই করি নিজেদের সাথে।

আমাদের সখ বদলায়, ভালোলাগার জিনিসগুলোর প্রতি অনিহা জন্মায়।
আমাদের অবস্থা হয় লাটাইয়ে বাঁধা মাঞ্জা দেওয়া সেই সুতোটার মতো যে কিনা ভোকাট্টা হওয়ার পরেও ঘুড়ির অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আসলে শেষ জেনেও শেষ না মানতে পারার মাশুল গুনতে হয় আমাদের মতো বেশিরভাগ মানুষকেই।
আসলে শেষ জেনেও এগিয়ে যাওয়াটা কঠিন।
কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে শেষের পরই একটা নতুন শুরু অপেক্ষা করে থাকে।
শেষ মানে যেমন একটা বছরের পর নতুন বছরের শুরু, তেমনই আবার একটা সূর্যাস্ত পেরিয়ে নতুন এক সূর্যোদয়ের পথে এগোনো।
যে শেষ একটা সম্পর্কে ইতি টানে, সেই শেষের পরই নতুন একটা সম্পর্কের সূচনা হয়।
আর রইল পড়ে সম্পর্ক আঁকড়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর কথা—
আসলে কেউই কিছুর অভাবে ফুরিয়ে যায় না।

ফুরিয়ে যায় শুধু বেলাশেষের মুহূর্তেরা যেগুলোর কথা মনে পড়লে আদতেই কান্না পায়।
ফুরিয়ে যায় কিছু কথারা যেগুলোর জেরে রাত ভোর হয়ে গেলেও চোখে ঘুম আসতো না।
ফুরিয়ে যায় কিছু প্রমিস যেগুলোর দায় বহুদিন শুধু একজনই বয়ে বেড়িয়েছে।
ফুরিয়ে যায় কিছু প্রিয় মানুষের হাসি যে হাসির মায়ায় সব কষ্ট ভুলে থাকা যেত।
কিন্তু শেষ যতই কঠিন হোক না কেন, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া কোনও শেষের পরই কিছু ফুরায় না।
কিছু থেমেও যায় না।
মৃত্যু অনিবার্য, আর এই মৃত্যুই পারে একজন মানুষের সমস্ত গল্পে ইতি টেনে তাকে স্মৃতির খাতায় বন্দি করতে।
কিন্তু সেই মানুষটিকে ঘিরে থাকা বাকিদের জীবন কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও থেমে যায় না।
আদতে ছোটগল্প বলে মনে হওয়া সব গল্পই, উপন্যাসের ছন্দে চলতে থাকে। আর জীবনও প্রত্যেকটা মানুষকেই একজন দক্ষ ঔপন্যাসিক বানিয়ে যায়।

ছবি ও লেখায়— সুবর্ণা পঞ্চানন তক্ষক

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *