কাফের,
দেখতে দেখতে ২০২১ এর নভেম্বর চলে এলো। উৎসবমুখর দিনগুলো কেটে গেল, কিভাবে কাটলো সেটা বড় কথা নয়, কেটে গেল এটাই আসল কথা। ইংরাজি বছরটাও ফুরিয়ে এলো যেন খুব তাড়াতাড়ি! অসুখের রাত বড় লম্বা হয় বটে তবু আমার মনে হচ্ছে অভিশপ্ত বছরটা বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেল। তবে দুঃখ শেষ হয়নি এখনো তা আমি জানি। শরৎ পেরিয়ে হেমন্তের পালা শুরু হয়েছে। হেমন্ত মৌনমুখর ঋতু… সকলের অগোচরে আসে আবার কখন যে চলেও যায় ঠিক টের পাওয়া যায়না।।
তোমার সাথে আর যোগাযোগ করবোনা তাই চিঠি লিখতে বসেছি। এই চিঠির কোনো গন্তব্য নেই, সেইজন্যই লিখছি। হেমন্তিকার আগমনে তুমি যে বেশ খুশি তা আমি জানি… কারণ শীত তোমার চিরকাল পছন্দের। হিমেল হাওয়া আর ভোরের কুয়াশা জানিয়ে দিচ্ছে তার আগমনবার্তা। তোমার জ্যাকেট আর সোয়েটারগুলো নিশ্চয় কাবার্ডে তাদের জায়গা করে নিয়েছে। আর আমার চোখে পড়লো আজ মাঠের ধারে ইতি উতি ছড়িয়ে থাকা শুকিয়ে যাওয়া কাশের দলগুলোকে। শীত আমার কোনোদিনই পছন্দের ছিলনা। হেমন্তিকাও আমার মনে সেভাবে জায়গা করতে পারেনি… তবে পাহাড় আমায় টানে। বেড়াতে যাবার জন্য সমুদ্র পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে বেছে নিতে বললে পাহাড়ই ফার্স্ট চয়েস হবে তবে সারাজীবন পাহাড়ে থাকার কথা এখনো ভাবতে পারিনা। একসময় ভাবতাম কোনোদিন সবকিছু ছেড়ে হারিয়ে যেতে হলে পাহাড়েই যাবো… কিন্তু বিশ্বাস করো এখন আবার আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে। তোমার মতো কাফেরের জন্য আলোকলতারা কেন হারিয়ে যাবে বলতে পারো!! নাহঃ! আমিও হারিয়ে যেতে চাইছিনা… একটা সাধারণ জীবন চাইছি যেখানে দিনের শেষে দুচোখে শান্তির ঘুম নামবে।।
তোমার থেকে কিছুই প্রাপ্তি ঘটেনি তা নয়, কিছু সময়ে সত্যিই তুমি আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছো। তবে পুরোনো কথা আর বলতে চাইছিনা, বলতে গেলে ভালো-খারাপ অনেককিছুই বলতে হবে। এই চিঠি লিখতে বসে অনেককিছুই আবার মনে পড়ে যাচ্ছে কিন্তু সেসব শুনতে তোমার ভালো লাগবেনা জানি। জন্মমাসের মতই তুমিও প্রয়োজনে শীতল আর উদাসীন… আর আমি উষ্ণতা মেখেছি আমার দুগালে। ‘অবসাদ’ শব্দটার মুখোমুখি সব মানুষই দাঁড়ায় কোনো না কোনো সময়। আজ থেকে ঠিক ১০বছর আগে আলোকলতার জীবনে একটা কঠিন সময় এসেছিলো, সেটা সামলেছিলাম। এই সময়টা আরও কঠিন তবে আশা জাগছে… এটাও একদিন সামলে যাবে। আমি পদশব্দ শুনতে পাচ্ছি। বহুদিন একভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পরে আলোকলতা খুব ধীরপায়ে হাঁটছে তোমার থেকে দূরে।।
এই চিঠি এক সাধারণ মেয়ের চিঠি যে তোমার প্রেমিকা হতে চেয়েছিলো। অবসাদের অন্ধকারে একবার ডুবতে শুরু করা মানুষ জানে কতটা হতাশা, কষ্ট আর ভয় ঘিরে ধরলে মানুষ তলিয়ে যেতে থাকে… আর এটাও জানে অন্ধকার গহ্বরে মুখ গুঁজলে কতটা নিশ্চিন্ত লাগে! অন্ধকার যে আলোর মতো অনিশ্চিত নয়! অবসাদ আসলে বোবা টানেলের মতো যেখানে ডুবে থাকলে তার শেষের আলো খুঁজতে আর ইচ্ছে হয়না। কোনো সূক্ষ ছিদ্রপথে আলো প্রবেশ করলেও অন্ধকারে অভ্যস্ত মানুষ চোখ বুজে নেয় তাড়াতাড়ি, চোখের চারপাশের চামড়াও অনিশ্চয়তার ভয়ে কুঁচকে ওঠে। বিষাদ কাটিয়ে আলোয় ফেরার লড়াইটাও কম কঠিন নয়। এমনকি লড়াইটা না লড়তে চাওয়ার হাজার কারণ ছড়িয়ে আছে আমাদের সমাজে। ভুল আমারই, পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে তোমাকে চিরস্থায়ী ভেবেছিলাম। চায়ে চুমুক দিয়ে আমার অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ছে… স্মৃতি আছে আমারও তোমাকে ঘিরে। হয়তো হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটা হয়নি বটে তবে মুঠোফোন সাক্ষী আছে বহু মায়াবী সময়ের।।
ফোনের গ্যালারিতে তোমার সেই ছবিটা আজও অমলিন। পরিপাটি ভাবে খাবার সাজিয়ে খেতে বসেছো তুমি ঘরোয়া পোশাকে। পায়েসের বাটি তোমার হাতে, দৃষ্টি সেখানেই নিবদ্ধ। কি দারুন সুখের মুহূর্ত বন্দী করে আমাকে পাঠিয়েছিলে। আমি মুছে ফেলিনি ছবিটা তবে দেখা হয়না তেমন! গতবছর আজকের দিনটা মনে আছে? তোমার মন্দ্রিত কণ্ঠস্বর হয়তো আবারও মোহিত করবে অন্য কাউকে! আলোকলতার বোধহয় তোমাকে বিশেষ কিছুই বলার নেই আর! বিদায়!
ইতি,
আলোকলতা