প্রথমেই ‘লেডি ভগীরথ’- কে তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তির জন্যে কুর্ণিশ জানাই। লেডি ভগীরথ নাম টি শুনে অবাক হচ্ছেন? পূরাণের ভগীরথের নাম কমবেশি সবাই জানেন; যিনি তাঁর ষাট হাজার পূর্ব পুরুষের প্রাণ ফেরাতে ব্রহ্মার তপস্যা করেছিলেন— মহাদেবের সহায়তায় পতিত পাবন দেবী গঙ্গাকে মর্ত্যে এনেছিলেন। পুরুষ ভগীরথের কাহিনী তো সবিস্তার আগেই শুনেছেন, কিন্তু ‘লেডি ভগীরথ’-এর নাম শুনেছেন কি? জানেন কি তিনি কী কাণ্ডটি করেছেন? তবে শুনুন— এই মহিলা ভগীরথ একা হাতে ৬০ ফুট কূপ খনন করেছেন মাত্র ৩ মাসে। ইনি হলেন কর্ণাটকের উত্তর কন্নড় জেলার সিরসি তালুকের অত্যন্ত সাধারণ একটি পরিবারের স্ত্রী গৌরী এস নায়ক। বয়স ৫১ বছর। পেশায় দিনমজুর।
কথায় আছে জলের অপর নাম জীবন— আর সত্যি বলতে মানুষ তো এই জীবনটুকু যাপন করার জন্যই প্রতি মুহূর্ত লড়াই করে চলছে। পৃথিবীর ৯৬.৫ শতাংশ জল হলেও ব্যবহারোপযোগী সুমিষ্ট জলের ভাণ্ডার যৎসামান্য। আমরা যারা নদীমাতৃক অঞ্চলে বা নরম মাটির রসালো ভূমিতে বাস করি তারা হয়তো জলের জন্য হাহাকার ঠিক কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা উপলব্ধি করতে পারবো না। কিন্তু যেখানে জলের যোগান তেমন নেই, যাদের প্রতিদিন জলের জন্য উৎসুক হয়ে থাকতে হয় তারা বোঝে জলের কদর কতখানি।
গৌরী দেবী তাঁর বাড়ির চারপাশে কিছু সুপারি ও নারকেল গাছ লাগিয়েছিলেন। বাড়ির কাছাকাছি কোনো জলের উৎস না থাকায় নিয়মিত গাছে জল দেওয়ার জন্য একটি কূপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কিন্তু কূপ খননের জন্য লোকবল ও অর্থবল কোনোটাই তাঁর ছিল না। যেটা ছিল, সেটা অদম্য ইচ্ছাশক্তি। ভাগ্যের কাছে না হারার প্রতিজ্ঞা ও নিজের কঠোর মনোবলের ওপর ভর করে সিদ্বান্ত নেন তিনি নিজেই কূপ খননের কাজ করবেন। যা ভাবা তাই কাজ— প্রতিদিন তিনি একটু একটুকরে পৃথিবীর গর্ভে নেমে যেতে থাকলেন। টানা তিন মাস দৈনিক প্রায় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা কাজ করার পর তিনি পৃথিবীর গর্ভ থেকে ‘জীবন’ অর্থাৎ জল তুলে আনতে সক্ষম হন। ৬০ ফুট খোঁড়ার পর উঠে আসে বহু কাঙ্ক্ষিত সাফল্য— জল। এই কাজ তিনি একা হাতেই করেছেন, তবে মাটি সরানোর জন্য তিন জন মহিলার সাহায্য পেয়েছিলেন। একার প্রচেষ্টায় জলের উৎস নির্মাণকে সাধুবাদ জানিয়ে গৌরী দেবীকে যোগ্য সম্মান দিতেই তাঁর প্রিয়জন ও প্রতিবেশীরা নাম দেয় ‘লেডি ভগীরথ’। এই উপাধি সত্ত্যিই তাঁর যোগ্য সংবর্ধনা।
একই সঙ্গে গৌরী নায়ক ধর্মস্থল গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পের একজন সদস্যা। গৌরীর সম্বন্ধে ডিআরডি স্কিম অফিসার বিনোদার কাছে মিডিয়া জানতে চাইলে তিনি জানান,“যখন গৌরী মিটিংয়ে আসেন, তখন তিনি শরীরের ব্যথা নিয়ে অভিযোগ করতেন। কিন্তু কূপ খননে তার কাজের কথা আমরা জানতাম না। আমরা যখন তার বাড়িতে গিয়েছিলাম তখনই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে সে কী করছে। যদিও গৌরির বয়সে, বেশিরভাগ লোককে বৃদ্ধ হিসাবে উল্লেখ করা হয়, তিনি দেখিয়েছেন যে মানুষের আত্মা যতক্ষণ না সমস্ত প্রাণীর প্রতি আবেগ এবং ভালবাসার আগুনে জ্বালানী হয় ততক্ষণ বয়স হয় না। গাছের প্রতি গৌরীর ভালবাসা তাকে এই মহান কৃতিত্ব সম্পন্ন করতে অনুপ্রাণিত করেছিল।” তাঁর বাড়ির চারপাশে এখন প্রায় ১৫০টি সুপারি গাছ, ১৫টি নারকেল গাছ ও কয়েকটি কলাগাছ শোভা বর্ধন করছে।
এ যেন একজন স্ত্রী— একজন মায়ের সংসার, সন্তান সামলে, দৈনিক মজুরি শ্রমিকের কাজ করে অবসরে তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে তোলার গল্প। গৌরী নায়ক-এর এই জীবন যুদ্ধ সিনেমার রঙির পর্দায় দেখা ঘটনার থেকে কিছু কম রোমহর্ষক নয়। তাঁর মানসিক দৃঢ়তা বয়স, লিঙ্গ, অর্থ— সকল বাহ্যিক প্রতিকূলতাকে জয় করে এগিয়ে দিয়েছে নতুন ইতিহাস গড়ার পথে।
কলমে– অর্যমা