রমলাদেবীর প্রথম সন্তান দ্বীপেশের স্ত্রী রক্তিমার গর্ভধারণের সংবাদে রমলাদেবীর উচ্ছ্বাস আজ বাঁধনছাড়া। তাঁর বংশের কুলপ্রদীপ আসছে বলে কথা। রমলাদেবী পারলে আজই নাতির নাম ঠিক করে ফেলেন। দশ মাস দশ দিন সেতো দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আত্মীয়-কুটুম্ব, পাড়াপড়শীরা প্রশ্ন তোলে, নাতিই হবে তার কী স্থিরতা? কে বলতে পারে হয়তো নাতনিই এল ঘরে! শুনে রমলাদেবী কানে আঙুল দেন।
এ কী অলুক্ষুণে কথা! তাঁর নিজের সুপুত্রকে নিয়ে দুধেভাতে সংসার চিরকালের, সেখানে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের প্রথম সন্তান সে কিনা পুত্র না হয়ে পুত্রী হবে? না না না, তবে তাঁর বংশে বাতি জ্বালবে কে? রমলাদেবী বরাবর কৃষ্ণ ভক্ত। কিন্তু মনের কোণের সমস্ত আশঙ্কাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে শুধু কৃষ্ণঠাকুর নয়, এহেন মন্দির নেই যেখানে তিনি পুজো পাঠালেন না, মানত করলেন না। রক্তিমার দুই হাত তাবিজে, মাদুলিতে ভরে উঠল।
কিন্ত হায়, বিধি বাম! ঘরে কন্যা এল। একে মেয়ে তায় কৃষ্ণবর্ণা, যতোই কেষ্ট ঠাকুরের শ্যামবর্ণে রমলাদেবী মোহিত হন না কেন, নিজের পৌত্রীর অমন কাজলবর্ণ ওঁর কাছে অসহনীয়। কৃষ্ণকলি বেড়ে উঠতে লাগল কিঞ্চিৎ অনাদরেই। দ্বীপেশ রক্তিমা নিজেদের সন্তানকে অবহেলা না করলেও তার ভবিষ্যত চিন্তায় আড়ালে তাদের দীর্ঘশ্বাস ও বাড়তে লাগল দিন দিন।
রমলাদেবীর ভগবান অবশ্য তাঁকে একেবারে বঞ্চিত করেননি। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র রূপেশের দুই পুত্র সন্তান, রূপ আর নীল। তাঁর বংশ একেবারে নির্বংশ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। তাদের প্রতি রমলা দেবীর আদর, ভালোবাসাও উজাড় করা। এমন অসম ভালোবাসা নিয়েই তিন ভাইবোন বেড়ে উঠেছে পাশাপাশি।
কৃষ্ণকলি বি.এ পাশ করে টিউশন করে নিজের হাতখরচ টুকু চালিয়ে নেয়। কালো মেয়েকে বিদায় করতে বাবা, মা আর বিশেষ করে ঠাকুমা অনেকদিনই উঠেপড়ে লেগেছেন। রূপ চিরকালই পড়াশুনায় তুখোড়, সে এখন বিদেশী চাকরি নিয়ে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে। তাকে নিয়ে তার ঠাম্মির গর্বের শেষ নেই। নীলটা খালি মানুষ হলোনা। বখে গেছে কম বয়সেই। এহেন নেশা নেই যা ও করেনা। বাড়িতেও আজকাল নেশার জিনিস নিয়ে আসে। কিন্তু ঠাম্মির নয়নের মণিকে কেউ শাসন করে সাধ্য কি?
রমলাদেবী আজকাল বিশেষ বাড়ি থেকে বেরোন না, বয়েস কাবু করেছে তাঁকে। এক দুপুরে বাড়ি সেদিন প্রায় ফাঁকা। রূপেশ আর দ্বীপেশ সস্ত্রীক গেছেন এক আত্মীয় বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে। কৃষ্ণকলি সেদিন নিজের ঘরেই বাচ্চাদের টিউশন পড়াচ্ছিল। হঠাৎ ঠাম্মির ঘর থেকে প্রচণ্ড শব্দ শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখে রমলাদেবী মেঝেতে পড়ে রয়েছেন নিঃসাড়।
হাসপাতাল থেকে ফোন পেয়ে রূপেশ, দ্বীপেশ আর বৌমারা যখন সেখানে পৌঁছয়, তখন তিনি স্থিতিশীল। কৃষ্ণকলি বরাবরই ভীষণ অনাড়ম্বর জীবনে অভ্যস্ত। নিজস্ব মুঠোফোন তার নেই, তাই সে কাউকে যোগাযোগ করতে ছিল অপারগ। নীল ঘরেই ছিল কিন্তু নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দিদির কথা বা পরিস্থিতির গুরুত্ব, কোনোটাই বোঝার মত মানসিক স্থিতি তার তখন ছিলনা, অগত্যা তার উপর নির্ভর না করে কৃষ্ণকলি নিজেই ঠাম্মিকে একটা ভ্যানরিক্সায় চাপিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডাক্তার বলেছেন ‘সেরেব্রাল অ্যাটাক’, বেশি দেরি করলে বিপদ বাড়ত।
রমলাদেবীর জ্ঞান ফিরেছে। কী আশ্চর্য, আজ তিনি প্রথমেই আর নাতির মুখ দেখতে চাননি, তিনি খোঁজ করেছেন কৃষ্ণকলির, দেখতে চেয়েছেন তাকে একটিবার। তাঁর চোখে আজ জল উপচে পড়ছে, তবে এই জল দুঃখের নয় বরং অনুশোচনার। অনুতাপের জ্বালায় আজ তিনি দগ্ধ।