শাড়ি বৈচিত্র্য তুলে ধরতে বাংলার শিল্পীদের কাজ কিছু কম নয়। বাঙালি আর শাড়ি এ সংযোগ অনেকটা নাড়ীর টানের মতোই। টাঙাইল, তাঁত ইত্যাদি শাড়ির নাম বহুল প্রচলিত আজকের দিনেও। বিয়েবাড়ি হোক কিংবা বাড়ির ছোট কোনো অনুষ্ঠান, বাঙালি নারী শাড়িতেই বাজিমাত। বালুচরী এরই একটি। এটি পশ্চিমবঙ্গের প্রসিদ্ধ একটি শাড়ি। ভারতের ভৌগোলিক স্বীকৃতি এবং বয়নশৈলীতে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পকর্ম এটি৷ আঁচলে বহু পৌরাণিক গল্প ও অন্যান্য নকশা-বোনা। এই শাড়ি আভিজাত্যের প্রতীক বলেও বিবেচনা করেন অনেকে৷ বালুচরী শাড়ি তৈরিতে মোটামুটি ১ সপ্তাহ বা তার বেশি সময় লাগে । এই শাড়ি ভারতের ভৌগোলিক অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়। বাংলার গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী এই বালুচরী।
তবে এর ও একটি ইতিহাস আছে। মুর্শিদ কুলি খাঁ ১৭০৪ সালে সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মকসুদাবাদে স্থানান্তরিত করার পর তার বেগমদের জন্য নতুন শাড়ি তৈরীর হুকুম দেন বালুচরের তাঁতশিল্পীদের। যথারীতি বালুচরের তাঁতিরা নতুন শাড়ি তৈরীতে মনোনিবেশ করেন। তারা যে নতুন শাড়ি সৃষ্টি করেন তাই বালুচরী নামে খ্যাত হয়। সেখানে এই শিল্পের শেষ বিখ্যাত কারিগর দুবরাজ দাস মারা যান ১৯০৩ সালে, তিনি চিত্রশিল্পীদের মত শাড়িতে নিজের নাম সই করতেন৷ সত্যি এও এক অভূতপূর্ব চিত্রকলা বটে।
মল্ল রাজাদের পৃষ্ঠপোষণে এই শিল্পের সমৃদ্ধি ঘটে৷ মল্ল রাজাদের সময়ে নির্মিত টেরাকোটার মন্দির ও অন্যান্য শিল্পের প্রভাব পড়ে এই শাড়ির নকশায়৷ শাড়ির মধ্যেও ভারতের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি প্রকাশ পায় বোঝাই যাচ্ছে। পরে ব্রিটিশ রাজত্বে অন্যান্য দেশীয় বয়নশিল্পের মত বালুচরীও দুর্দশাগ্রস্ত হয়৷ বালুচরীও নিজ গৌরব হারাতে বসে। রেশম বালুচরীতে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে তৈরি হয় অনেক নতুন ধাঁচের বা ধরনের শাড়ি৷ এক বা দুই রঙের সাধারণ বালুচরী, রঙে ঝলমল মীনাকরী বালুচরী, গুরুদাস লক্ষ্মণ আবিষ্কৃত স্বর্ণচরী, অমিতাভ পালের সৃষ্টি রূপশালি ও মধুমালতী, অমিত লক্ষ্মণের সৃষ্টি দ্রৌপদী বালুচরী (মহাভারত টিভি সিরিয়ালের দ্রৌপদীর সাজসজ্জার অনুকরণে) ইত্যাদি এর নানা প্রকার৷ বালুচরির বুনন বংশানুক্রমিকভাবেই চলে আসত। কিন্তু পরবর্তীতে এর শিল্পীরা অন্য দিকে চলে যাওয়ায় এর অস্তিত্ব সংকট দেখা যায়। তবুও বলা যায়, বাংলার সংস্কৃতির সাথে আজও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এই ঐতিহ্যবাহী বালুচরী শাড়ি।