গানগল্প

সময়টা তখন ১৯৭৫, যখন বাংলা মূলধারার গান ভীষণ ভাবে অবদমিত , ঠিক সে সময়েই সঙ্গীত জগতে ‘ব্যান্ড’ শব্দের উন্মোচন ঘটাল কয়েকটি ছেলে৷ সবাই তাদের চিনল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ নামে৷ পাশ্চাত্য রক সঙ্গীত এবং বব ডিলানের ‘ ফোক মুভমেন্ট’ – এর প্রতিচ্ছবি দেখাল তারা তাদের গানের মধ্য দিয়ে৷ টেলিভিশন যে আমাদের কতটা আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে, পৃথিবী যে আজ হাতের নাগালে- ওরাই বলেছিল৷ দূরত্ব যে আলোকবর্ষ সমান হতে পারে ওরা দেখিয়েছিল৷ ‘ ভেবে দেখেছো কি’ আজও কোনো ঘুম না আসা রাতে কিংবা এক মনখারাপি বিকেলে হেডফোনে বেজে ওঠে৷
পলাশ যে শুধু বসন্তে ফোটে ওঠে না: আবেগেও ফোটে, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ শিখিয়েছিল আমাদের…

বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের একটি বর্ণ ‘চন্দ্রবিন্দু’ – সেই নামেই এল আরো এক ব্যান্ড, ১৯৯৮ সালে৷ গানপ্রেমীদের মন জয় করে নিল চন্দ্রিল, উপল, অনিন্দ্যদের অনবদ্য উপস্থাপনা৷ ওরাই প্রেম আর মনকে একে অন্যের পরিপূরক দেখাল, ওরাই তো, ‘ব্যথার আদরে অবুঝ আঙুল ‘ রাখল৷ পাশ্চাত্য পোশাকের প্রতি অনুরাগকে ব্যাঙ্গাত্মক অথচ শ্রুতিমধুর করে বলল ‘ আজকালকার মেয়ে গুলো সব স্মার্ট’৷ ঘুমভাঙা আদরের কলকাতায় চন্দ্রবিন্দু ভাসাল, ‘আদরের নৌকা’৷ ও হ্যাঁ , বাচ্চারা কিন্তু আজ এদের জন্যেই বলে-
‘ এ জুজু, এ জুজু আমাকে থাবা দিও না,
এ জুজু , এ জুজু তুমি তো জুজুসোনা’ !!

লোকগানের আদলে গান শোনাতে ১৯৯৯ সালেই এসেছিল,
‘ভূমি’৷ তার সাথে ছিল আধুনিকতাও৷ অনেক প্রেমিক যারা প্রেমিকার থেকে ‘ ক্যাবলা’ উপাধি পেয়েছিল, বস্তুত তাদের জন্যেই ছিল ‘ ওরম তাকিও না’…
অপেক্ষারত প্রেমের জন্য ছিল-‘তোমার দেখা নাই রে’৷ মনখারাপের সাক্ষী ছিল-‘ কান্দে শুধু মন কেন কান্দে রে’….আজও ভূমি সবার প্রিয়৷

‘ভালোবাসা মানে ধোঁয়া ছাড়ার প্রতিশ্রুতি’ কিংবা ‘ভালোবাসা মানে যে ‘দূরভাষ নিশ্চুপে শুনে ফেলে অনুভূতির হাসি’- একথা বলতে ১৯৯৬ সালে এল সেই সময়ের আরো এক উল্লেখ্য ব্যান্ড,
‘পরশপাথর’৷ বিরহের কঠোর ছোঁয়া দিয়ে ওরা শোনাল- ‘ এই মধুমাসে বধূ এসো কাছে’৷ ‘ইচ্ছেডানা’ বলল এক আকাশ স্বাধীনতার কথা…

ভাঙা প্রেম যে আদতে আর জোড়ে না, বড়ো হওয়ার দৌড়ে শৈশবের ‘হলুদ পাখি’ কোথায় উড়ে যায়,১৯৯২ সালে বলল ক্যাকটাস৷ হার্ড রকের আদলে বাংলা গানে আনল নতুন জোয়ার৷ এক বিতর্কিত সময়ের গান ‘যুদ্ধ এসেছে’ আজও প্রাসঙ্গিক৷

‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ যে যুগের সূচনা করেছিল, ১৯৯৮ থেকে আজ- এই ১৮ বছর ধরে সেই যুগের সার্থক প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে ফসিলস্৷ রূপম ইসলামের অনবদ্য সঙ্গীত আর বিশেষতঃ অ্যালেনের গীটারে প্রতিটি গানই আজ রকপ্রেমীদের মনের কাছাকাছি৷ ফসিলস্ই সাহস রাখে সমাজের মুখে ‘অ্যাসিড’ ছোঁড়ার কথা বলার৷ ফসিলসই বলতে পারে চোরা বাইসাইকেল সীটে ফ্রী তে যৌনতা দেওয়ার কথা৷ এভাবেই রক মন্ত্রে উদ্দীপিত হোক রকদুনিয়া…

পুনশ্চ :- যে সব ব্যান্ডের কথা নেই এখানে, লাফালাফি তাদের অসম্মান করছে এমন নয়৷ সবার আরো উন্নতি হোক, বাংলা সঙ্গীতের আরো উন্নতি হোক এটাই লাফালাফির কামনা৷

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *