মায়েরা এরকমই হয়

আজ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। টুবাই এর আজ ভীষণ আনন্দ।
এতদিন ধরে সে এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। কারণ তার বহুকিছু প্ল্যান করা আছে যে এই পরীক্ষাকে ঘিরে।

টুবাই ধনী বসু পরিবারের একমাত্র সন্তান। তাই ছোট থেকেই সে নিজের ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নেওয়াতে অভ্যস্ত।
তার মা কয়েকবার শাসন করার চেষ্টা করলেও বাড়ির অন্যদের আহ্লাদে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। তাই ধনী পরিবারের আহ্লাদী স্বেচ্ছাচারী ছেলে হিসাবেই পরিচিত ছিল সে পাড়ায়।
আজ পরীক্ষা শেষ তাই ঠাকুমার আদেশে তার আদরের নাতি টুবাই এর জন্য পঞ্চব্যঞ্জন রান্না হচ্ছে।

(কলিং বেলের শব্দ)

– মা, ও মা, দরজাটা খোলো তাড়াতাড়ি।
– যাচ্ছি, যাচ্ছি দাঁড়া।
ঘরে ঢুকেই টুবাই স্কুলের পোশাকটা পাল্টে বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নিল।
– কিরে দাদুভাই, বাড়ি এসেই আবার কোথায় যাবি? এই তো এলি একটু বস।
দেখ তোর জন্য তোর পছন্দের কত কি রান্না হয়েছে আজ। একটু তো মুখে দিয়ে যা।
– না দিঠাম্মি এখন সময় নেই গো একদম।
– কেন রে টুবাই কোথায় যাবি তুই?
– মা, আজ আমার দাদুর বাড়ি যাবার কথা। মনে নেই তোমার।
– হ্যাঁ আছে। কিন্তু দেখ বাবা এই তো মাধ্যমিক দিলি। এখনই বাইকটা কেনার কি খুব দরকার?
আগে ভালো করে পড়াশুনো কর, মানুষ হ, নিজের পায়ে দাঁড়া, তারপর না হয় কিনিস। দেখবি নিজের রোজগারে কিছু কেনার আনন্দটা অনেক বেশী।
– এই শোনো মা, ফালতু বোকো না তো। তুমি এসব বুঝবে না। এখন একটা গাড়ি না থাকলে চলে। রাহুলের বাবা আগের মাসে স্টেটস্ থেকে ফিরে রাহুলকে একটা চার লাখ টাকার গাড়ি কিনে দিল। ভিকিকে ওর পিসি ছ লাখের একটা বাইক গিফট্ করল ওর বার্থডেতে। তোমরা কি দিয়েছ আমাকে? খুব বেশী হলে একটা দশ হাজার এর একটা ঘড়ি আর বাইশ হাজারের সাইকেল। এসব এ না আর চলেনা। দিন পাল্টেছে, সময় পাল্টেছে।
– ঠিক আছে সব বুঝছি। কিন্তু দেখ বাবা আজকাল তোর বয়সী ছেলেদের অ্যাক্সিডেন্টও তো কম হচ্ছে না তাই ভয় করে। আর বাবু আমরাও তো বড়ো হয়েছি মানুষ হয়েছি কই এত বিলাসিতা তো পাইনি..
– তো তোমরা পাওনি বলে আমিও পাব না?
– না, সেটা না। তোকেও তো আমরা বিলাসিতা দিয়েছি। কিন্তু তুই এখন যেটা করছিস সেটা বিলাসিতার আধিক্য। যেটা ঠিক না। মা তো তোর, তাই তোকে মানুষ করতে চাই। জীবনে পুঁথিগত শিক্ষার থেকে মায়ের শিক্ষাটা অনেক বড়ো রে..
– এই প্লিজ তোমার সেই এক বাণী। চুপ করো তো। আর তোমার এত প্রবলেম কিসে। দিচ্ছে তো আমাকে দাদু। তোমার বাবার পয়সা যাচ্ছে বলে কি তোমার গায়ে লাগছে নাকি?
– টুবাইইই….লজ্জা করে না তোর মাকে অপমান করতে? মাকে কষ্ট দিয়ে কখনও কারোর ভালো হয় না এটুকু জেনে রাখিস।
কারণ একটা বাচ্চাকে জন্ম দেওয়া থেকে মানুষ করা পর্যন্ত মা কে তার নিজের সব শখ আনন্দ ভুলে মুখ বুজে হাসি মুখে সকল কষ্ট সহ্য করতে হয়। সেসব বোঝার বয়স তোর এখনও হয়নি কিন্তু সম্পর্ককে টাকা দিয়ে বিচার করার বোধ তোর এসে গেছে।
– উফ্ , চুপ করো তো। দিঠাম্মি আমি এলাম……..

ভাই…. গাড়িটা তো সেরা হয়েছে। চল ভাই আজ একটু ঘুরে আসি। আচ্ছা আজ এই আনন্দের দিনে একটু খানাপিনা না হলে ঠিক জমেনা। এই টুবাই চল না ভাই।
– ঠিক আছে তুই সামনের বার টাতে গিয়ে অর্ডারটা দে। আমি রাহুলকে নিয়ে তেলটা ভরিয়ে আসছি।
– উফ্ আজ বহুদিন পর এত ড্রিঙ্ক করলাম। চল রাহুল, টুবাই আজ একটা রেস হয়ে যাক।
– চল
-চল
1,2,3 অ্যান্ড স্টার্ট………

পাঁচ মিনিট পর একটা বিশাল আওয়াজ আর আলোর ঝলকানি দেখে চারদিকের ধাবা গুলো থেকে অনেকে ছুটে এল……

(কলিং বেলের শব্দ)
– বৌমা দেখ দাদুভাই এল মনে হয়। একটা বাইক এসে থামল দরজার বাইরে…..
(অাবার পুনরায় কলিং বেলের শব্দ)
– যাচ্ছি, যাচ্ছি দাঁড়া….

-এটা কি মি. অর্ক বসুর বাড়ি? আপনি কি অর্ণব বসুর মা?
– হ্যাঁ বলুন।
– বাইপাসে একটা বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। যাতে আপনার ছেলেও ছিল। ওকে সেন্ট্রাল হসপিটাল এ নিয়ে যাওয়ে হয়েছে আপনি প্লিজ তাড়াতাড়ি চলুন। আপনাকে ও খুঁজছে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্মিত হেসে মায়া বলল..
– হ্যাঁ চলুন ।
-আপনি হাসছেন যে?
– আমি জানতাম…..

– মা, মা আআআআআ……..
– কাঁদছিস কেন টুবাই….
– মা আমার দুটো পা আর নেই…
– দেখ বাবু মায়েরা অর্ন্তযামী হয়। তারা বোঝে তার সন্তানের কখন কি হতে চলেছে…
এই ষোলোটা বছর ধরে তো তোকে অনেকবার শিক্ষা দিতে চেয়েছি পারিনি। আজ নিজের শিক্ষা নিজে পেলি। এটার দরকার ছিল রে…..
– সরি মা, আর কখনও তোমার অবাধ্য হওয়ার মতো বড়ো ভুল আর করবো না। ক্ষমা করে দাও এবারের মতো….
-নে আর কাঁদিস না, একটু ঘুমিয়ে নে। আমি একটু এক জায়গায় যেতে হবে। তোর বাবার ব্যবসায় অত বড়ো ক্ষতি হওয়ায় তোর কৃত্রিম পা আনবার ব্যবস্থা হলেও অপারেশনের ব্যবস্থা হচ্ছিল না।
তাই… দেখিস আবার আগের মতো হাঁটতে পারবি….
– মাআআআ…….
মায়া ছেলের কপালে একটা স্নেহ চুম্বন দিয়ে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে চলল সোনা বাজারের পথে…
ছেলের অপারেশনের জন্য নিজের সর্বস্ব বিক্রি করতে……..

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *