দেওয়ালি পুতুলের ঐতিহ্য আর পশ্চিম মেদিনীপুর

মেদিনীপুরকে বলা যেতেই পারে মৃৎশিল্পের তথা দেওয়ালি পুতুলের গর্ভগৃহ। কাঁসাই বা কংসাবতী নদী যা মৃৎশিল্পের প্রাণশক্তি বা নিবিড়যোগের স্থাপনাকার। সময়ের অগ্রগতি অনেক কিছুই কেড়েছে; তবে ঐতিহ্য সময়কে ঠিক আপন বানিয়ে নেয়।

এরকমই হলো পশ্চিম মেদিনীপুরের মাটির পুতুলের সম্ভার। টেপা পুতুল, জো পুতুল, মাটির হাতি, ঘোড়ার পাশাপাশি আছে বিখ্যাত দীপাবলি পুতুল বা দেওয়ালি পুতুল। আঠারো শতকে অধুনা ঝাড়খন্ড থেকে একদল কুমোর পুরুলিয়ার বলরামপুর, ছাতাটাঁড় আর কুক্কুড়ু গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তাদের হাতেই প্রথম তৈরী হয় দীপাবলি পুতুল। পরবর্তীতে তা মেদিনীপুরে ছড়িয়ে পড়ে, আর এর প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে পশ্চিম মেদিনীপুর শহরের মির্জাবাজার কুমোরপাড়া।

দেওয়ালি পুতুল আর পাঁচটি সাধারণ পুতুলের গড়নের দিক থেকে খানিকটা ভিন্ন। স্কুলগুলির নলাকার দুই হাতের অংশটি কাঁধ বরাবর ডান ও বামদিকে কিছুটা প্রসারিত হয়ে মাথার ওপরে উঠে গেছে। অনেকটা ত্রিভুজের মতো দেখতে। হাতের সম্মুখ অংশটি হয় প্রদীপাকৃতি বা মাটির ডিবরি- কুপি লাগানোর জায়গা করা থাকে। এই দেওয়ালি পুতুলের মাধ্যমে কখনও কখনও রাবণের সীতাহরণ, দেবী দুর্গা, মা কালীর রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়। আলোর উৎসবে পুতুলের বিক্রিও গড়নের ওপর নির্ভরশীল। পাঁচটি হাতের প্রদীপ থেকে, পঁচিশটি হাতের প্রদীপ, সর্বোচ্চ পঞ্চাশ হাতের দেওয়ালি পুতুলের রমরমা চলে।
দেওয়ালি পুতুল তৈরিতে যেমন হাতের কাজ হাতের কাজ থাকে।তেমনি চাক- ছাঁচেরও সাহায্য নেওয়া হয়। এক একটি পুতুলের উচ্চতা দশ- বারো ইঞ্চি থেকে দু- তিন ফুটেরও হয়। অবশ্য এখন দু- তিন ফুটের পুতুল বিরল, বরাত দিলেই তৈরি হয়। নচেৎ ছোট পুতুলেরই চাহিদা বেশি। দশ- বারো টাকা থেকে আশি-একশো দাম হয় পুতুরগুলির। পুতুল তৈরিতে মূলত উপকরণ হিসেবে বালি, মাটি আর রঙের ব্যবহার হয়। বর্ষার সময়েই নদীর পলিমাটি আর বালি মিশিয়ে এই পুতুল তৈরির কাজ শুরু হয়। বিভিন্ন রঙের ছোঁয়ায় পুতুলের সাজসজ্জা আর ঘাঘরা ছাঁচের বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট এই পুতুলগুলির ঘাঘরায় নানা রঙিন চিত্র ফুটে ওঠে।

কোনো কোনো দেওয়ালি পুতুল ঘোড়ায় উপবিষ্টা। হাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে এক অন্ধকার দূরীভূতা নারীর অবয়ব যেন রণক্ষেত্রে অশ্বারোহী এক নারীর ঝলক দেখায়। জ্যোর্তিময়ী নারীদের প্রতীক যেন এই পুতুল। অন্ধকারকে পেছনে ফেলে আলোর উৎস সন্ধানের শরিক এই দেওয়ালি পুতুল। বর্তমানে এলিডি, টুনির জ্বালায় অতিষ্ঠ হলেও, পশ্চিম মেদিনীপুর কিন্তু এখনও এই ঐতিহ্যকে নিভতে দেয়নি, দেদার ভাবেই দেওয়ালি পুতুল এর আর্কষণ চলে, চলছে, চলবে।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *