শৈশবের অলিগলি। একটা ঘটনার কথা বলি বরং। স্কুলে পড়ি তখন। গোঁফের রেখা ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে। হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্টে পৌঁছতে বেশি দেরি নেই। পড়ার চাপে চোখের তলায় কালি, লিখে লিখে হাতের আঙুলে কড়া পড়ার উপক্রম।
দিনটা ছিল গরমের ছুটি পড়ার আগে শেষ ক্লাস। চারদিকে বেশ খুশি খুশি ভাব। এমনকি ক্লাসের বিখ্যাত ঘুমকাতুরে পল্টু, সে একটিবারের জন্যও ক্লাসের মধ্যিখানে ঘুমিয়ে পড়েনি। প্রত্যেক পিরিয়ডের শেষে সুবীর একের জায়গায় তিনবার করে অন্যদের ব্যাগে খাদ্য অনুসন্ধান পর্ব চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর আমি সংস্কৃত বইয়ের দেবনাগরী হরফের শ্লোকগুলো এক নিঃশ্বাসে গড়গড়িয়ে পড়ে ফেলে ঘরসুদ্ধ আটচল্লিশটা ছাত্রসমেত নিশীথস্যারকে পুরো অবাক করে দিয়েছি। ফার্স্ট বয় অরুণ যেভাবে কটমট করে চাইছিল, তাতে দিব্যি বোঝা গেল ব্যাটা বেশ রেগে গেছে।
লাস্ট পিরিয়ডটা ছিল রমেশবাবুর। সেই বিরক্তিকর সম্পাদ্য। আমি আবার বেছে বেছে এই দিনগুলোতেই জ্যামিতি বাক্সটাকে ব্যাগে ভরতে ভুলে যেতাম। এর থেকে কম্পাস ওর থেকে স্কেল চেয়ে আঁকতে হত।
এসবে কি যায় আসে, আমি পিচে নেমেই দারুণ ফর্মে। চারটে অঙ্কেই চারটে পাহাড়প্রমাণ রাইট। ক্লাসের শেষে স্যার আমাকে বোর্ডটা মুছতে ডাস্টারটা এগিয়ে দিলেন। এটা একটা প্রথা। রমেশবাবুর পিরিয়ডে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। যার ওপর উনি সন্তুষ্ট হন, তাকে এই কাজটা দেন। আমি দিগ্বিজয়ীর মতো ছাতি ফুলিয়ে এগিয়ে গেলাম।
অরুণ একটু আগেই বকুনি খেয়েছিল। এবার আড়চোখে ওকে দেখে মনে হল কেঁদে ফেলবে। আমি হাসি চেপে বোর্ড মুছে ডাস্টারটাকে বেশ করে দেওয়ালে পেটাতে লাগলাম। এটা ছাড়া মজা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
সেটাই কাল হল। আমার যে ধুলোয় মারাত্মক অ্যালার্জি সেকথা বেমালুম ভুলে গেছি। হাঁচিটাকে আর রোখা গেল না। রাউন্ড ওয়ান শুরু হল। হাঁচতে হাঁচতে কুঁজো হয়ে গেলাম। আমায় ধরতে গিয়ে স্যারের হাত থেকে প্রেজেন্টের খাতা, কাঠের বিরাট চাঁদা – সব মাটিতে পড়ে গেল। ততক্ষণে ফ্যাচ ফ্যাচ থেকে হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো-তে আমার প্রমোশন হয়েছে।
অরুণ বোধহয় শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাসবার চেষ্টা করছিল। কতটা সফল হচ্ছিল তা বলা মুশকিল। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে শান্ত হয়ে গেল। একেবারে বাকরুদ্ধ! ইতিহাসের আন্দাজে লেখা এক নম্বরের প্রশ্নগুলো হুট করে ঠিক হয়ে গেলে যেমনটা হয়।
আমার তখন চোখের জলে নাকের জলে অবস্থা। মেঝেতে বসে পড়েছি। কোনোমতে চোখ খুলে দেখলাম, হাঁচির দমকে হাতের ডাস্টারটা উড়ে গিয়ে ইতিমধ্যে অরুণের নতুন চশমাটাকে নক আউট করে দিয়েছে।
কাচের চশমা তো, অতি সহজে হার স্বীকার করে নেয়। মনিবের প্রাণের জিনিস। যাকে নিয়ে সে সারাটা বছর আমাদের মাথা চিবিয়ে খেয়েছে। তবে কিনা কাচ ভাঙা শুভ।
অরুণ তা বুঝেছিল বলে মনে হয় না। কারণ পরিচিতজনমাত্রই জানেন, আমাকে ছুটির পর বিকেলের ব্যস্তমুখর রাস্তায় আর দেখা যায়নি। ভাগ্যিস গরমের ছুটিটা ছিল…
আরেকখানা ঘটনা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। কলেজের লাস্ট ইয়ার। বছরের গোড়ার দিক। পিঠে ডানাদুটো হয়তো বা গজিয়েছে, সাহসও কিঞ্চিৎ বেড়েছে। পূবালীর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে আমার আর অস্বস্তি লাগে না। তনিমা সাইকেলে লিফট চাইলে কিংবা প্রমীলাদের সঙ্গে লাইব্রেরির দিকে পা বাড়ালেই ও আমার জামার হাতা খামচে ধরে। ওর এমন আচরণগুলোকে মোটেই অস্বাভাবিক লাগেনি কোনোদিন।
স্টেশন থেকে কলেজ যেতে বেশ কিছুটা সময় লাগত। আমি আবার বরাবরই চায়ের মানুষ। শীতকালে অমন ধোঁয়া-ওঠা ধামসা সাইজের কেটলিগুলোকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় আমার জ্ঞানভান্ডারে জমা ছিল না। তায় শীতকাল। ভোর হোক, সকাল হোক, বেলা হোক, রাত্তির বারোটা হোক, চায়ে আমার কখনোই না নেই। রোজ কলেজ যাওয়ার পথে এককাপ গিলে তবেই যেতাম।
দোকানওয়ালারা ছিল দুইভাই। দুজনই যমজ। বাপটুদা আর ননীদা। একই ছাঁটের কাঁচাপাকা চুল। হুবহু একইভাবে চা বানানোর পদ্ধতি। কাগজের কাপে ঢালতও কপিক্যাটের কায়দায়। সকালে পালা করে একজন আর সন্ধে নামলে দুজনই দোকানে। প্রতিদিনের খদ্দের ছিলাম তো, তাই একবারেই চিনে ফেলতাম। কপাল ভালো হলে চিজের লেয়ার দেওয়া একটা পাঁউরুটি ফাউ হিসেবে জুটে যেত। অবশ্য তাড়া থাকলে টিফিন কৌটোয় ভরে নিতাম। স্বাদের বর্ণনা দেওয়ার বিন্দুমাত্র ধৃষ্টতা আমি করছি না।
রবিবারের সন্ধেগুলোতে আমার দায়িত্ব বেড়ে যেত। পূবালীর বাংলা টিউশন শেষ হত আটটার পরে। ওকে ট্রেনে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরতাম।
সাতটার পর থেকে বাপটুদা-ননীদার নাভিশ্বাস ওঠার মতো হাল। প্রথমজন ফুলুরি ভরছে ঠোঙায়, অপরজন ফুটন্ত চা ঢালছে। লোকে নাম গুলিয়ে ফেলতে ফেলতে কেতরে পড়ছে। যাদের কাপে তরলের লেভেল আদ্দেক নেমে গেছে, তারা যাত্রার ভঙ্গিতে ভুঁড়ি দোলাতে দোলাতে ক্যাডাভ্যারাস বকেই চলেছে অনবরত। কেউ কেউ আবার কূটকচালে বাক্যালাপে মশগুল।
আকাশে বেশ মেঘ। ঠান্ডাটা তাই হয়তো একটু কম। গলায় জড়ানো মাফলারটা ভাঁজ করে কোমরে বেঁধে নিলাম। ভিড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে চা-টা নিতে হাত বাড়াব, এমন সময় পাশের কেঁদো বাঘ গোছের লোকটি চেঁচিয়ে উঠল। ব্যাপার বিশেষ কিছুই না। লোকটা সম্ভবত ফুলুরির দাম দিতে যাচ্ছিল। ডানহাতে নোট, অন্যটায় চায়ের কাপ। সামান্য ধাক্কা লেগে চা চলকে পায়ের আঙুলে পড়েছে।
“অ্যাই! তুই তো আচ্ছা কাছা-খোলা ছোকরা। উফ, পাটা পুড়ে গেল। আদা দেওয়া চা-টাও নষ্ট করে দিলি।”
কুড়ি বছর বয়েস আমার। সর্বাঙ্গে গরম রক্ত বইছে। মাসি-কাকিমারাও সচরাচর তুই বলেন না। কোথাকার অপরিচিত লোক কিনা আমাকে এসব বলছে!
কীভাবে রাগ সামলে নিলাম কে জানে। বললাম, “আপনি তো পিছনে তাকিয়ে গল্প করছিলেন। খেয়াল করে এগোবেন তো নাকি!”
“বটে! তুই নিজে ব্যাটা চারচোখো। এদিকে কানাদের মতো চলিস বুঝি!”
বাপটুদা বলল, “আরে দুত্তোর! খামোকা ঝামেলা পাকাবেন না দাদা। আপনাকে আরেকটা চা দিচ্ছি এক্ষুনি…”
“আরে এসব উল্লুকদের চেনা আছে আমার…” বলেই আচমকা তেড়ে এল লোকটা। বজ্রমুষ্টিতে দুকাঁধ চেপে ধরল। আমি ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। পারফিউমের উগ্র গন্ধে নাক সুড়সুড় করছে। যাচ্ছেতাই বাজে গন্ধ মেখেছে লোকটা।
“আরে তুই বিশু না? গেল হাটবারে আমায় খুব ঠকিয়েছিলিস। স্পষ্ট মনে আছে, সাতাশটা কমলালেবুর মধ্যে থ্রি ফোর্থ পচা বেরিয়েছিল। তোকে ছাড়ছি না।”
আমি অঙ্কের ছাত্র। থিয়োরেম পড়ে পড়ে মুখ পচে গেল। আমাকে এসেছে হিসেব শেখাতে।
বলতে চাইছিলাম, “সাতাশের থ্রি ফোর্থ তোমার মুন্ডু। যত্তসব বটতলার হিসেব তোমার কাছেই রাখো” , কিন্তু গন্ধের চোটে নাকের ভেতর সুড়সুড়ির আন্দোলনে কিছু বলতে পারছিলাম না।
“আরে দাদা, যাকে তাকে দোষ দেবেন না। ও অভি, ওকে ছোটো থেকে চিনি। আপনি কি চোখের মাথা খেয়েছেন?” বাপটুদার মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেছে।
“ও, তুমি বোধহয় ফিফটি ফিফটি শেয়ার পাও, তাই না? তাই এত দরদ। অ্যাই শিগগির পয়সা ফেরত দে। দে বলছি…”
আমি আর সামলাতে পারলাম না। মানুষের মুখের ওপর হাঁচা চরম অসভ্যতা। কিন্তু আমিও যে নিরুপায়।
লোকটা ছিটকে সরে গেল। আর বাঁধন আলগা হতেই পড়িমরি করে ছুটলাম। চা চুলোয় যাক। ঘড়িতে সাড়ে আটটা। ইস! বেচারি মেয়েটা কতক্ষণ অপেক্ষা করছে!
এরপর আরেকটু বাকি আছে। পূবালীকে দেরি হওয়ার কৈফিয়ত দিতে যাচ্ছিলাম, তখনই ও বলল, “তুমি শুধু শুধু কষ্ট করে আসতে গেলে অভিদা। আজকে আমার কাকামণির আসার কথা ছিল। অবশ্য এসে পৌঁছোননি এখনও।”
“আর বোলো না, ফালতু ঝামেলায় পড়ে গেসলাম। আমাকে একজন বলে কিনা আমি হাটে কমলালেবু বিক্রি করি। মা শুনলে রাতের খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।”
“আমাদের তো কমলালেবু কিনতেই হয় না। কাকামণি শীতের সময় গুচ্ছের নিয়ে আসেন। এমনিতে চাকরিসূত্রে মানকুন্ডুতে থাকেন। বিয়ে-থা করেননি। সেখান থেকে সরাসরি ট্যাক্সি ভাড়া করে গোটাদশেক থলে নিয়ে সোজা আমাদের বাড়ি। বছরে একবারই। অতিরিক্ত পরিশ্রম একদম সহ্য করতে পারেন না।”
আমি বললাম, “খুব বয়স্ক বুঝি?”
“না না। বাবার মেজ ভাই। তবে বড্ড মোটা চেহারা ওনার।”
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “খুব রা-রাগী নিশ্চয়ই?”
“কেন বলতো?”
“না এমনি। নিছক কৌতূহল।”
“হ্যাঁ খুব রাগী মানুষ। পান থেকে চুন খসলেই খিটখিট করেন। তবে বাড়ির সবার জন্য গিফট আনেন। কেউ বাদ পড়ে না।”
“তুমি কি উপহার পাও?”
“ধুর! খালি সেন্টের শিশি। যাচ্ছেতাই গন্ধ। ও আমি ট্রাঙ্কে পুরে রেখে দিই। পছন্দ হয়নি বলতে পারি না। বাড়িসুদ্ধ সবাই তো তোমায় চেনে। ওনার সঙ্গে পরে না হয় আলাপ করিয়ে দেব।”
আমি টের পেলাম জামাটা ঘামে ভিজে গেছে।
ক্রমশ…
পর্ব-১ঃ অলিগলি