পরিযায়ী পাখিরা যখন আসে তখন আকাশে বাতাসে একটা আনন্দ লেগে থাকে। প্রকৃতি নতুন করে সেজে ওঠে। পরিযায়ী পাখি দের দেখার কারণে ভিড় জমে অগণিত দর্শকদের। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে পরিযায়ী শব্দটা শুনলেই শ্রমিক দলের দুর্দশায় কেঁপে ওঠে বুক।
করোনার দাপটে দেশজুড়ে দুমাসেরো বেশি সময় ধরে লকডাউন অব্যহত। প্রভাব পড়েছে জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়। তবে কোনো হিসেবনিকেশ ছাড়াই আচমকা এই লকডাউনের বেশিমাত্রায় প্রভাব পড়েছে ভারতবর্ষের পরিযায়ী শ্রমিক শ্রেণির ও তাঁদের পরিবারের ওপর।
দেশজুড়ে লকডাউনের জেরে বন্ধ সমস্তরকম ছোটোবড় কলকারখানা আর তার ফলেই কাজ হারিয়েছেন কোটি কোটি শ্রমিকরা। কাজ হারানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের নূন্যতম রোজগারের পথও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনিশ্চয়তা সঙ্গে নিয়েই দিনের পর দিন ঘরে ফেরার আশায় সরকারের দিকে মুখ চেয়ে বসেছিলেন পরিযায়ী শ্রমিক দল। তবে সরকার মুখ ফিরে দেখার আগেই হাঁটা পথের শ্রমে ভর করে অগুন্তি শ্রমিক রওনা দিয়েছেন ঘরে ফেরার উদ্দেশ্য নিয়ে যাতে তারা দুবেলা দুমুঠো খেয়ে অন্তত বাঁচতে পারে।
সরকার শ্রমিকদের দিকে যখন ফিরে তাকিয়েছে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে ১৬ জন শ্রমিকের। প্রমাণ হিসেবে পড়েছিল শুকনো কয়েকটি রুটি। এই দৃশ্য দেখলে মানবিকতায় বিঁধে। তবে দোষটা কার! ওই নিরীহ পরিযায়ী শ্রমিক দলের যাঁরা সরকারের আশায় না থেকে, কোনোরকম সরকার বিরোধী অভিযোগ না করে হাঁটা পথে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ক্লান্ত হয়ে রেললাইনের ওপরই শুয়ে পড়েছিলেন তাঁদের? নাকি দরিদ্রদের পরোয়া না করা সরকারের! নাকি আমাদের! প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হলে কিছুটা হলেও নিজেদের দোষী তো মনেই হয়।
এই লকডাউনে আমরা এমন কিছু দৃশ্য দেখেছি যা আমাদের মানবতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছে কোটি কোটি শ্রমিক, তাঁদের হাতে না ছিল টাকা, না ছিল খাবার, তবুও তাঁরা কোনো অভিযোগ ছাড়াই হেঁটে গেছেন কিলোমিটারের পর কিলোমিটার। পায়ে জুতো নেই, তপ্ত রোদে পুড়ে যাওয়া পা থেকে বেরোচ্ছে গলগলিয়ে রক্ত তবুও তারা হেঁটেই যাচ্ছেন। তবে আমাদের এত বড় গণতান্ত্রিক দেশে, গণতন্ত্র কোথায় যেখানে জনসংখ্যার সিংহভাগ সর্বদা বঞ্চিত থেকে যায়!
একটা হাইওয়েতে আমরা দেখতে পাই এক পরিযায়ী শ্রমিক খিদের জ্বালায় রাস্তায় পড়ে থাকা মরাপঁচা কুকুরের দেহ থেকে মাংস তুলে খাচ্ছে। এ দৃশ্য কল্পনা করলেও বুক কেঁপে ওঠে আর এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে চাক্ষুস দেখতে হচ্ছে এই দৃশ্য। তবুও তাদের কোনোও অভিযোগ নেই, তারা শুধু সুষ্ঠুভাবে বাড়ি ফিরতে চেয়েছে। আর তাঁদের জন্য এটুকু করতে পারিনি আমরা। তবে সোনু সুদের মতো ব্যক্তিত্ব এখানে সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। তিনি নিজ দায়িত্বে বাড়ি ফিরিয়েছেন হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিককে। যা আমাদের সরকার করে দেখাতে পারেননি, তা করে দেখিয়েছেন সোনু সুদের মতো ব্যক্তিত্ব।
তবে সরকার এতদিনে মুখ ফিরিয়েছে, শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে। তবে যখন মুখ তুলে দেখলোই তখন এত দেরি কেন! বিদেশ থেকে প্রবাসীদের ফেরানোর সময় প্লেনের ব্যবস্থা করার সময় তো একবারের জন্যও পিছপা হয়নি সরকার। তবে সমস্ত দুর্ভোগ চিরকাল দরিদ্রদের সহ্য করতে হবে! মুখোমুখি করে দেয় অনেকগুলো প্রশ্নের। আর সবথেকে বড় প্রশ্ন হল মানবিকতা আজ কোথায়!
এই পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার গল্পটা হয়তো গল্প হলেই ভালো হতো। কিন্তু এটাই কঠিন বাস্তব, বুর্জোয়াদের জাঁতাকলে চিরকাল তাদের শোষিত হওয়ার কঠিন বাস্তব।