‘ইলিশ’ নামটা খাদ্য রসিক বাঙালির কাছে একটা আবেগ, একটা সুখকর অনুভূতি। কথায় আছে মাছে ভাতে বাঙালি আর সেই বাঙালির মাছেদের রানী বা রাজা (দ্বিমত সাপেক্ষ) হল ইলিশ। এটি এমন একটি মাছ যাকে ভাজা, ঝোল, সরষে বাটা, ভাপা নানা রকম ভাবে খাওয়া যায়। যারা কাঁটার ভয়ে এই মাছটি খান না তারা সত্যিই হয়তো এক সুন্দর স্বাদ থেকে বঞ্চিত হন। আসলে বর্ষার মরশুম বাঙালির কাছে ইলিশের আগমন ছাড়া প্রায় অসম্পূর্ণ।
ইলিশ মাছের বিজ্ঞান সম্মত নাম হলো Hilsha Hilsha যা অনেকক্ষেত্রে Tenualosa Ilisha নামেও পরিচিত। এটি Clupeidae পরিবারের হেরিং প্রজাতির মাছ।
চিত্র : সংগৃহীত
ভারতীয় উপমহাদেশের খাদ্যোপযোগী মাছ গুলির মধ্যে ইলিশ একটি জনপ্রিয় মাছ। এটি বাংলাদেশের জাতীয় মাছ; ২০১৭ সালে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রক এর আওতাধীন Department of Patents, Designs and Trademarks (DPDT) ইলিশ মাছকে বাংলাদেশের পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রধানত বিশ্বের উৎপাদিত ইলিশের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলায় সর্বাধিক বিখ্যাত ইলিশ মাছ পাওয়া যায়, যা রপ্তানি করা হয়। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যেও ইলিশের উৎপাদন দেখা যায়। ইলিশ মাছের অন্যান্য নাম গুলি হল জাটকা, এলিস, পাল্লা মাছ, ইলীহ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। তামিল ভাষায় ইলিশ মাছকে উল্লামিন, অসমীয়া ভাষায় ইলীহি, গুজরাটি ভাষায় মোদার বা পালভা, ওড়িয়া ভাষায় ইলিশী ও তেলেগু ভাষায় পুলাসা নামে ডাকা হয়। ইরাকে এটি স্বুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে এটি তেরুবক নামে পরিচিত। ইলিশ মাছ ইষৎ লোনা জলে জন্মায়, এটি ৩ কেজি ওজন পর্যন্ত ও দৈর্ঘ্যে ৬০ সেমি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
এই মাছের সর্বাধিক প্রজননের হার দেখা যায় এপ্রিল মাসে, তবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত নদীতে সর্বাধিক এই মাছের উথ্বান লক্ষ্য করা যায়। ইলিশ মাছ বাংলাদেশের মেঘনা-যমুনা, পদ্মা নদী এবং ভারতের গঙ্গা, রূপনারায়ণ, নর্মদা ও গোদাবরী নদী থেকে অধিক পরিমাণে আহরণ করা হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য ভারতের চিল্কা হ্রদ ইলিশ মাছ চাষের এক বিখ্যাত জায়গা।
বাঙালিরা বর্ষাকালে সব থেকে বেশি ইলিশ মাছ খেয়ে থাকে। যদিও এখন সারা বছরই এই মাছ স্টোর করে রাখার জন্য বাজারে এর জোগান অব্যাহত থাকে। তবে বর্ষাকালে উৎপন্ন ইলিশের স্বাদই হয় আলাদা। প্রায় প্রতিটি বাঙালি বাড়ির বর্ষাকাল ইলিশের আগমনে সম্পূর্নতা লাভ করে।
চিত্র : সংগৃহীত
খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা মনে হয় প্রতিটি বাঙালির বর্ষার মরশুমের প্রিয় খাদ্য। তবে এই মাছকে বাঙালিরা শুধু খিচুড়ির সাথেই আবদ্ধ রাখেনি।
চিত্র : সংগৃহীত
কখনও পান্তাভাতের সাথে ইলিশ মাছ ভাজা কিংবা গরম ভাতের সাথে মাছের তেল ও মাছ ভাজা মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে।
চিত্র : সংগৃহীত
আবার কখনও সরষেবাটা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে সরষে ইলিশ কিংবা নারকেল ও সরষে বাটা দিয়ে করা ইলিশ ভাপা বা পাতুরি
চিত্র : সংগৃহীত
কিংবা কালোজিরে দিয়ে ইলিশের তেলঝোল বা বেগুন আলু দিয়ে সাধারন ঝোল বাঙালির স্বাদের ভাগকে শতগুনে বৃদ্ধি করেছে।
চিত্র : সংগৃহীত
অনেক বাঙালি হিন্দু পরিবারে সরস্বতী পুজো কিংবা লক্ষী পুজোর দিনে শিল্প বা জ্ঞান কিংবা আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য একজোড়া ইলিশ মাছ এনে দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়।
চিত্র : সংগৃহীত
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের ঘাটতির কারণে বিবাহে মাছ উপহার হিসাবে এই মাছ ব্যবহৃত না হলেও বাংলাদেশে এই ঐতিহ্য এখনও অব্যাহত রয়েছে। তবে শুধু স্বাদের জন্যই এই মাছ বিখ্যাত নয়, এই মাছের পুষ্টিগুনও প্রচুর। ইলিশে Omega 3 ফ্যাটি আ্যসিড রয়েছে যা রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে এবং মানবদেহের ইনসুলিন স্তর কে সুরক্ষিত রাখে। এছাড়া তৈলাক্ত মাছ হওয়ায় এটিকে অনেক কম তেলেই রান্না করা যায় ফলে মানবদেহে অতিরিক্ত তেল সঞ্চয়ের সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
বাঙালির খাদ্য তালিকায় ইলিশের নামডাক থাকা সত্ত্বেও, এই নিয়ে বাঙাল ঘটির দ্বন্দ্ব চিরকালীন। কিন্তু আমার মতে ইলিশের মতো সুস্বাদু মাছ বাঙাল না ঘটির সেই দ্বন্দ্ব ভুলে একে সর্বজনীন ভেবে নিয়ে নিজেদের খাদ্য তালিকায় যোগ করাই শ্রেয়। তাই বলি এই বর্ষার মরশুমে বৃষ্টির সাথে সাথে ইলিশের স্বাদ মন ভরে উপভোগ করুন; ইলিশে থাকুন, ইলিশে বাঁচুন।