-“বিয়েটা পেছোতেই হবে রে মিতিল, এই পরিস্থিতিতে বিয়েটা করা কিকরে সম্ভব বল!”
-(অনুচ্চ দীর্ঘশ্বাস) “জানিরে অভি, এখন আমাদের সব থেকে বেশি প্রয়োজন ফিল্ডে সামনে থেকে কাজ করা, afterall it’s an emergency.”
-“সেই, আর এতদিন যখন দুজন সবটা হাসিমুখে সামলেছি তখন না হয় আর কটা দিন ও পারবো, কি বলিস?! জানিস যতদিন তুই আমার পাশে আছিস, আমার কোনো চিন্তা নেই।”
-“আমি থাকি বা না থাকি তুই কাজ চালিয়ে যাবি সবসময়, মনে রাখিস ওই মানুষগুলো তোর ফার্স্ট প্রায়োরিটি।”
-“মিতিল প্লিজ, তোকে ছাড়া যে আমি ভাবতেও পারিনারে…”
মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বছর থেকে মিতিল আর অভিষেক প্রথমে বেস্ট ফ্রেন্ড তারপর প্রেমিক-প্রেমিকা। বছর দুয়েক হলো দুজন পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে হাসপাতালে চাকরি শুরু করেছে। এতদিনের সম্পর্কটাকে এবার তারা একটা প্রাতিষ্ঠানিক নাম দিতে চায়। দুই পরিবারও ভীষণ খুশি তাদের এই সিদ্ধান্তে। কিন্ত দুতরফেই আয়োজন ও প্রস্তুতি যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন সব পরিকল্পনা ব্যর্থ করে ঘনিয়ে এসেছে এক নতুন বিপর্যয়। জেলা, রাজ্য, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে অতিমারী। কোভিড ১৯ ওরফে করোনা ভাইরাস নামক অনুজীবের করাল গ্রাসে জনজীবন বিপর্যস্ত। সমাজের সব স্তরের মানুষ নিজের সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যাচ্ছে এই মারণ রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচতে। স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে পুলিশ বাহিনী, নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের জলাঞ্জলি দিয়ে “ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র” হয়ে অবতীর্ণ হয়েছে এক অসম যুদ্ধে, এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে। চিকিৎসক হিসেবে তার ব্যতিক্রম হয়নি মিতিল আর অভিষেক এর জীবনেও। দিনের পর দিন হাসপাতালে এক অমানুষিক পরিশ্রমের পর দিনান্তে তাদের প্রাপ্তি কখনো সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর হাসিমুখ আবার কখনো মৃত্যুর মতো কঠিন বাস্তব। এভাবেই চলছিল তাদের বর্তমান দৈনন্দিন জীবন। বিয়ে, পরিবার এসব একপ্রকার ভুলতেই বসেছে দু জনে। ক্রমশ আশা নিরাশার দোলাচল বাড়ছিল তাদের দুই পরিবারেও। মানুষের জীবনের আগে ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য তারা কোনোদিনই দেয়নি ।আজও তার অন্যথা হয়না। সমাবর্তনে নেওয়া হিপোক্রিট শপথকে তারা মেনে চলে সর্বতোভাবেই। তাদের বিয়ে আর নতুন জীবনের স্বপ্নটা আপাতত অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত। রোজ ডিউটির শেষে ভিডিও কলে একে অপরকে যেটুকু দেখতে পায় সেটাই এই মৃত্যু মিছিলে পরম প্রাপ্তি মনে হয়। নিজেদের ওইটুকু একান্ত সময়ে অবশ্য ওরা নিজেদের নিয়ে স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দেয়নি একেবারে। এই স্বপ্নগুলোই তো হাজার অনিশ্চয়তার মাঝেও মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে,ভালো রাখে। ওরা স্বপ্ন দেখে একটা রোগমুক্ত পৃথিবীতে ওদের সুখী দাম্পত্য জীবনের।
এর মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস। পৃথিবী এখন সেরে উঠছে ধীরে ধীরে। টীকা তৈরী হওয়ার পর মহামারীর প্রকোপও কমতে শুরু করেছে। মানুষ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে আস্তে আস্তে। কিন্তু সম্পূর্ণ রাশ টানা যায়নি এখনো। ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, সাফাইকর্মী সবাই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সামলে চলেছে সবটা। অভি ও বাকি চিকিৎসকদের মতো কর্তব্যে অবিচল। প্রতিদিন ডিউটিতে বেরোনোর আগে সে এসে দাঁড়ায় মিতিলের সামনে। মিতিল যেন হাসে ওকে দেখে আগের মতোই, খুশি হয় যে অভি ওকে দেওয়া কথা রেখেছে, নিজের দায়িত্ব পালন করে চলেছে প্রতিদিন। দেওয়ালে বাঁধানো ছবিটাতে মিতিল সদাহাস্যময়, ওর এই হাসিটাই এখনো অভির প্রাণশক্তি। নাহ্, ওর ছবিতে চন্দন, মালা কিছুই পরাতে দেয়নি ও। মিতিল বেঁচে আছে ওর মধ্যে, ওর চারপাশে, সেই সমস্ত মানুষের মধ্যে যাদের বাঁচাতে বাঁচাতে একদিন সে নিজেই আক্রান্ত হয়ে পড়ে। নির্মম ভাইরাসটা শুধু ওর শরীরটা কেড়ে নিয়েছে পৃথিবী থেকে।মিতিল কে শেষ দেখা দেখতে পায়নি ওরা কেউই। নিয়ম অনুযায়ী প্লাস্টিকে মুড়ে ওর দাহ সম্পন্ন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই। তাতে অবশ্য বিন্দুমাত্র দু:খ নেই অভির। ওর ওই শীর্ণ, নিস্তেজ, অক্সিজেনের অভাবে নীল হয়ে যাওয়া চেহারাটার স্মৃতি ও মনে রাখতেও চায়নি। তার চেয়ে ওর ঝলমলে, ছেলেমানুষিতে ভরা মুখটাই মনে রয়ে যাক সারাজীবন। বিয়ে সে আর করবেনা। সমাজকে সাক্ষী রেখে সিঁদুরদানেই শুধু বিয়ে হয়না, মনের মিলটাই তো শেষ কথা, আর সেই হিসেবে তার আর মিতিলের বিয়ে তো সেই কবেই হয়ে গিয়েছিল…
ফোনটা বেজে উঠল অভির,হাসপাতাল থেকে ফোন, যেতে হবে এবার ওকে। মিতিল বা মিতিলের মতো আরও অনেকের রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে হবেই তাদের সবাইকে যারা আজ স্বজন হারিয়ে পেছনে রয়ে গেছে। ভাইরাস যাদের কেড়ে নিল, তাদের আত্মত্যাগকে জয়ী করতে হবে। “কোভিড যোদ্ধা” ডাক্তার অভিষেক নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সব অপ্রাপ্তি আর স্বজন হারানোর দু:খকে সরিয়ে রেখে একবার নিজের কর্তব্য পালনে উদ্যত হলেন। আর দেওয়ালে টাঙানো এক অজেয়া নারীর ছবিটা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।