তিতাস (তৃতীয় পর্ব)

তিতাস তৃতীয় পর্ব

(১)

কালো মেঘ গুলো কেটে গেছে। ধীরে ধীরে সূর্যের লাল আভা এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে মাটি। উত্তপ্ত সূর্যের রৌদ্র এসে খেলা করছে অবলীলায়।
কালিম্পং এর ছোট্ট গ্রাম লোলেগাঁও। অগনিত রাশি রাশি পাইনে গাছের পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে রৌদ্র যেন লুকোচুরি খেলায় ব্যাস্ত। স্নিগ্ধ একটা সকাল। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে বা কফির মগে চুমুক দেওয়ার মতো একটা সকাল। উষ্ণতার পরশে শরীর জুড়িয়ে নেওয়ার মতো একটা শান্ত সকাল।
আর এই অপরূপ আলোর ছটায় এক অভিনব সৌন্দর্যের স্পর্শ মেখে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট কাঠের একতলা-দোতলা বাড়ি গুলো। সম্ভবত এগুলো স্থানীয় বাসিন্দা দের ঘর-বাড়ি। তবে বহু প্রবাসী রাও এখানে স্থায়ী ভাবে কেউ বা অস্থায়ী ভাবে বসবাস করে।

এমনই একটি ছোট কাঠের বাড়ির দোতলার বারান্দার সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে ছোট্ট একটি ফুটফুটে মেয়ে। চুল গুলো অবিন্যস্ত ভাবে ছড়িয়ে আছে পিঠে-ঘাড়ে। মুখখানা একেবারে মায়ায় ভরা। ঠিক এই কালিম্পং এর এই স্নিগ্ধ সকাল টার মতো। চোখ দুটো নিবদ্ধ নীচের ছোট ঝিল টির উপর। ঝিলের স্বচ্ছ জলের মাঝে রৌদ্রের আলোর তারতম্য বোঝার চেষ্টায় রত দুটি ছোট্ট চোখ। থমথমে মুখ টা বড্ড আদুরে বড্ড মায়াবী।
ঘরের মধ্য থেকে তখনও প্রচন্ড চিৎকার ভেসে আসছে। জিনিসপত্র ভাঙার শব্দে খানখান হয়ে ভেঙে যাচ্ছে নিস্তব্ধতা।
ছোট মেয়েটি আবার সেদিকে তাকিয়েই কান দুটো হাত দিয়ে প্রানপন চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
দেখতে দেখতে উঠে দাঁড়ায় সে, তারপর দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নামে। গ্রাউন্ড পেরিয়ে ছুটতে থাকে ওকে-পাইন ঘেরা রাস্তার দিকে…।

(২)

কালিম্পং থেকে একটা ট্যাক্সি গাড়ি পাওয়া যেতেই তাতে উঠে পড়ে উপাসনা, উপাসনা রায়চৌধুরী। প্রাপ্ত-বয়স্ক এই নারীর মুখ কাঠিন্যতার পারদ দিয়ে ঢাকা। বয়সের তুলনায় রূপ এখনো অপূর্ব।
চন্দননগর গার্লস হাই স্কুলের অধ্যাপিকা উনি। বেশ রাশভারী মহিলা। ভূগোলের পাঠ ছাত্রীদের পড়াতে পড়াতে একসময় নেশা ধরেছিল পাহাড় ঘোরার।
কালিম্পং শহরটার প্রতি তাঁর অদ্ভুত এক টান। তবুও কর্ম-ব্যাস্ততার কারনে কখনো আসা হয়ে ওঠে নি। আজ এভাবে এই অবস্থায় যে তাঁকে উদ্বিগ্ন হয়ে সেই চন্দননগর থেকে এক প্রকার ছূটে আসতে হবে তা সে কখনো কল্পনা করতে পারেনি।

গাড়িতে যে দু-চারজন আরো লোক ছিল, তারা কিছুটা দূর গিয়েই নেমে পড়ে। এখন গাড়িতে একা সে একা। বেশ স্বচ্ছন্দবোধ হচ্ছে এবার তার। খুব একটা ভিড়-গ্যাঞ্জাম পছন্দ নয় তাঁর। একা থাকাতেই যেন সুখ খুঁজে পায় সে। যদিও এই মুহূর্তে তাঁর সমস্ত সুখ আনন্দ একটা নামের মাঝেই আটকে আছে, আর সে হলো ‘তিতাস’।

তিতাসের কথা মনে পড়তেই উৎকন্ঠা আরও বাড়তে থাকে উপাসনার। ছোট্ট একরত্তি মেয়েটি না-জানি কী অবস্থায় আছে এখন! ছোট্ট তিতাস তখন ছিল আরোও ছোট, বছর তিন কি সাড়ে-তিন হবে, চন্দননগর এসেছিল ওর বাবা-মায়ের সাথে। তখন দেখেছিল উপাসনা, তিতাস কে। ছোড়দার বিয়ে উপলক্ষে এসেছিল ওরা। ছোট্ট পরীর মতো দেখতে মেয়েটির কোমর হেলিয়ে নাচ নজর কেড়েছিল উপস্থিত সকলের। ওই একরত্তি ছোট্ট মাসুম মেয়েটির তো কোনো দোষ ছিল না, তবে ও কেন এর শাস্তি ভোগ করছে! ভাবতে পারে না উপাসনা, জাস্ট ভাবতে পারে না। নীলিমা আর অভিরূপের যদি এমনটাই করার ছিল, তবে কেন তারা তিতাস কে নিয়ে এলো পৃথিবীতে? উত্তর খুঁজেও পায় নি সে। নিজেদের ইগো-স্ট্যাটাস আর উগ্র উচ্চাকাঙ্খা কীভাবে একটা সাজানো-গোছানো সংসার ভেঙে তছনছ করে দিতে পারে তা এদের না দেখলে বুঝতে পারতো না উপাসনা। জাস্ট নিজেদের কথায় ভেবে গেছে এই দম্পতি। ইনফ্যাক্ট এখনও ভেবে যাচ্ছে। মেয়েটার কথা কীভাবে ভুলতে পারে ওরা! আর ভাবতে পারে না উপাসনা। মাথাটা অসহ্য যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম।
নিজেকে যতটা পারে শান্ত রাখার চেষ্টা করে সে। জানালার কাঁচ খুলে কালিম্পং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে মনোনিবেশ করার প্রয়াস করে সে।

কালিম্পং এর প্রকৃতি যেন ঈশ্বরের প্রতিদান। প্রকৃতি নিজের সর্বস্ব রূপ যেন ঢেলে দিয়েছে দুহাতে। ঘন সবুজ রঙ দিয়ে সাজানো কোনো চিত্রপট। শিল্পীর তুলির টানে যেভাবে প্রস্ফুটিত হয় অপূর্ব চিত্রপট, ঠিক তেমন। ঘন সবুজ অরণ্যের বুক চিরে যেন কোনো মায়াবী রহস্য হাতছানি দেয়। পাইনের জঙ্গলে ঘেরা সরু আঁকাবাঁকা পথ ধরে গাড়ি এগিয়ে চলছে প্রকৃতির অপরূপা ছোট্ট গ্রাম লোলেগাঁও এর অভিমুখে।

গাড়ি ছুটছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে। পাইনের সারি সারি গাছ গুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রাগৈতিহাসিক এর ছায়া হয়ে। না-জানি কত যুগ ধরে তারা এভাবে একই স্থানে দন্ডায়মান। না-জানি কত যুগের হাসি-কান্নার ইতিহাস জমা আছে তাদের বুকে। নিত্যকার নতুন নতুন মানুষের সমাগমে ভরে ওঠে এ শহর। তাদের সবাই এর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা ধৃতিমান হয়ে।
সূর্যের স্নিগ্ধ আলো গাছের ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে উপছে পড়ছে মাটির বুকে। সোনার মতো ছড়িয়ে দিচ্ছে উষ্ণতা রাশি রাশি।
উপাসনার তবু যেন অস্থির মন। বারবার দেখছে হাতের ঘড়ির কাঁটা।

— আর কতক্ষন ভাইয়া?
— জ্বী মেমসাব, আউর তোড়ি দের বাদ পোঁহুচ জায়েঙ্গে।
— গাড়ি একটু তেজ চালাও।

গাড়ির ড্রাইভার হিন্দিভাষী, তবে বাংলা বোঝে। বলতে হয়তো কষ্ট হয়।

— জ্বী মেমসাব, ইসসে জাদা তেজ চালানা মানা হ্যায়। আগে খাদ হ্যায় না ইসিলিয়ে। পাহাড়ি ইলাকা, কাঁহা ক্যায়া হ্যায় কিসে মালুম…!
— আচ্ছা, আচ্ছা যেমন যাচ্ছে তেমনই চলুক।

বেশি কথা বলা পছন্দ করে না উপাসনা। বিরক্ত হয় সে। এখন না হয় চিন্তিত সে, কিন্তু যদি সবকিছু ঠিক থাকা অবস্থাতেও কোথাও ট্রাভেল করে তখনও সে এমনটাই। চুপচাপ থাকে। জার্নি করার সময়টা সে অন্যভাবে উপভোগ করতে ভালোবাসে। প্রকৃতির মাঝে চোখ দুটি নিবদ্ধ রেখে ভেসে চলে কল্পনার আকাশে, অথবা প্রিয় উপন্যাসিকার পাতায় গড়ে তোলে কল্পিত চরিত্রের চড়াই-উতরাই।
হ্যাঁ, এমনই সে। পৃথিবীর সব মানুষ তো আর এক রকম হয় না, তাই সে হয়তো আলাদা। নাকি নিজেকে সে আলাদা রাখতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে! কি জানি!
কিছু সংখ্যক মানুষ সর্বক্ষণ মেতে থাকে হৈ-হুল্লোড় আনন্দ নিয়ে। আর কিছু মানুষ আনন্দের সাথে ভাসতে বড্ড ভয় পায়, গুটিয়ে রাখে নিজেকে সর্বক্ষণ।

আবার কিছু মানুষ এমনও থাকে যারা প্রথমে উচ্ছল চঞ্চল থাকলেও কোনো এক বিশেষ ঘটনার শিকার হয়ে থামিয়ে নেয় নিজেকে বা বলতে পারো গুটিয়ে রাখে এক শক্ত খোলসে।
উপাসনার ক্ষেত্রেও তাই। সে তো আগে এমনটা ছিল না! তারও আনন্দ ছিল, উচ্ছ্বাস ছিল, আবেগ ছিল, অনুভূতি ছিল। তবে কেন সে আজ এমন? কৃশানুর মৃত্যুই কি তবে দায়ী এর জন্য? উত্তর খুঁজেও পায় নি সে। তবে কৃশানু কে হয়তো আজও ভুলতে পারে নি উপাসনা।

ঘোর কাটে ড্রাইভার এর কথায়-
–আপ কাঁহা কি রেহনেবালি হ্যায় মেমসাব?
উত্তর পায় না ড্রাইভার। তবুও সে দমে না। আরও অন্য গল্প শুরু করে দেয়।-
— আপ নাহি জানতে হ্যায় মেমসাব, ইধার কা রাস্তা বড়া ড্যাঞ্জারাস হ্যায়, দিখনেমে তো বহুত হি সোন্দর, লেখিন কব কাঁহা ক্যায়া জাল পাতা হ্যায় মালুম নেহি।

এবারেও কোনো প্রত্যুত্তর পায় না ড্রাইভার টি। অগত্যা নিজের ভাষায় একটি গান ধরে গাড়ির তেজ বাড়ায়।
সকালের রৌদ্র আলোর আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ছুটতে থাকে একাকী সওয়ারী একটি গাড়ি।

উপাসনার চোখ বুঝে আসে। সিটের একপাশে এলিয়ে দেয় মাথাটা। আর কিছুক্ষণ, তারপরই সে তার তিতাসের কাছে পৌছে যাবে। তিতাসের চোখ থেকে সব ক্লান্তি হতাশা মুছে দেবে সে। ভাবতেই মাথাটা হাল্কা হয়ে আসে তাঁর।
(ক্রমশ)

–অরুণিমা

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *