নিয়নগঞ্জে আমাদের একটি পুরোনো বাড়ি ছিল। মাটির দাওয়ায় ছিল, একটা সজনে গাছ ছিল। স্মৃতির পাতায় এমন না-জানি কতই না টুকরো স্মৃতি জমা আছে। মাটির বাড়ির দাওয়ায় জুড়ে শীতের নরম রোদ এসে আলাপ জমাতো বাড়ির কচি-বুড়ো সদস্যদের সনে।
আমরা অর্থাৎ আমার কাকামশাই, জ্যাঠামশাই, কাকিমনি,জ্যাঠিমনি,বড়ো দাদা-দিদিরা সবাই একসাথেই বাস করতাম। আনন্দের হাট বসতো যেন আমাদের সেই মাটির এক-চিলতে নিকানো উঠোনে। তখন সেই পরিবার পরিজন ঘিরে কতই না আদর আলাপন, খুনসুটি-হুটোপুটি। এই সব টুকরো স্মৃতি গুলো না জানি কোন অতলে চাপা পড়ে যায়, বয়স বাড়ার সাথে সাথে। কখনো হয়তো এমন একটা নলেন গুড়ের মতন রোদের তাপে সেঁক পড়ে স্মৃতির পাতায়। একে একে উন্মোচন ঘটে কত না-পাওয়ার মাঝেই হারিয়ে যাওয়া এক অমূল্য শৈশবের! তার কি কোনো হিসেব আছে নাকি?
সজনে গাছটার নীচে বসতো শীতের দুপুরের আসর। সব ভাই-মিলে একটা সংসার সংসার রান্নাবাটির খেলা খেলতাম। ঠাকুমার পানের কৌটো থেকে কোনোদিন চুরি করতাম পানের খিলি। সেদিন একটু অন্য রকম আমেজ থাকতো আমাদের। সে যেন এক অন্য দুপুর! রোদের সেঁকে শরীর সেঁকতে সেঁকতে ডুবে যেতাম ঘর-কন্নার খেলায়। যেন খুব বড়ো হয়ে গেছি আমরা। একথা ভাবতেও তখন বেশ দারুন লাগতো। এখন মন চাই, ছেলেবালাতেই ফিরে যায়,হায়!
শীতকাল এলেই খুব বেশি করেই মনে পড়ে এই সব ছোটোবেলার ঘটনা গুলোর কথা। স্মৃতির আঙিনা জুড়ে তখন কমলালেবুর খোসার মতো আস্তে আস্তে খুলে পড়ে হারানো সেই স্বল্প কথা!
এখনকার ছেলেমেয়েদের এভাবে খেলার ইচ্ছেটাই নেই। সব অ্যানড্রয়েড ফোন নিয়েই ব্যাস্ত। আমাদের সময় এমন ফোনের রমরমা ছিল না। ইনফ্যাক্ট আমদের ছোটোবেলায় ফোন কি তা চোখেই দেখেছিলাম না। যখন গ্রাজুয়েট করতে শহরে এলাম তখন ফোন এর সাথে পরিচয় ঘটে।
কতরকমের খেলা ছিল- হাডুডু, কানামাছি, কুমিরডাঙা, ছুঁয়াছুঁয়ি, সেপ্টেপিন লুকানো আরও কত কি। অত কি আর মনে থাকে! তবে একটা কথা এখনও আমার বেশ স্পষ্ট মনে আছে, তখন ক্লাস সিক্স কি সেভেন হবে হয়তো- একদিন মায়ের খুব শরীর খারাপ, আমি স্কুল যেতে পারিনি। সেদিন আমাদের ক্লাসে একটি স্পেশাল ক্লাস হওয়ার কথা ছিল। আমার অনুপস্থিতির কারনে সেদিন টা আমার মিস যায়। সামনে ছিল বোর্ড এক্সামিনেশন। পরের কয়েকটা দিনও যেতে পারিনি। মায়ের সুস্থ হতে সময় লেগেছিল সপ্তাহ দুয়েক। ততদিনের নোটস গুলো জোগাড় করতে প্রচুর কষ্ট হয়েছিল আমার। এখনকার সময় হলে তো ফোন মারফত সবকিছুই সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া যেত। আমার মেয়ের বেলাতেই দেখি ফোন থেকেই সবটি করে নেয়।
আসলে সমস্তটাই সময় আর পরিস্থিতির দায়।
তখন আমাদের ছোটকা অন্য রাজ্যে থাকতেন চাকরির সুবাদে। মাসে দশে বাড়ি ফিরতেন। ছোটকার ছেলে সুনয়ের সে কি অভিমান হতো। সপ্তাহে দুই দিন ছোটকার চিঠি আসতো। ছোটো কাকিমনির সেদিন মন খুব ভালো থাকতো। এখন তো কত্ত সুবিধা। ফোন অন করলেই ভিডিও কল করে তুমি দেখতে পাবে সবাইকে (যাকে ভিডিও কল করবে)।
এত সুবিধা হওয়ার পরও মনে হয় ফিরে যায় সেই পুরোনো দিনে! মনটা উদাস হয়ে যায় মাঝে মাঝেই। তখনকার মতো খোলা হাওয়া কোথাও পায় না আর। সেই ভোর হতেই শিশিরভেজা ঘাসের উপর দিয়ে নগ্ন পায়ে হাঁটা! ইসস! সে কি আর ভোলার। স্মৃতির পাতায় জমা থাকুক এ অমূল্য সম্পদ।
-অরুণিমা