“বন্ধুত্ব কারে কয়, আব্বা?” আমার পাঁচ বছরের ছেলে আবদুল জিজ্ঞেস করল।
ওর একটা প্রশ্ন আমার মনে অনেক কিছু জাগিয়ে দিল।
আচ্ছা সত্যি তো বন্ধুত্ব কী? বন্ধু কাকে বলব?
সেই ছেলেটা যে রোজ আমার সাথে কাজ করে, সে কী বন্ধু আমার?
নাকি রিমাদি, যে রোজ আমার জন্য খাবার আনে?
বসে খানিক ভাবলাম, না উত্তর কিছুতেই মেলে না যেন।
আবদুল হাত নাড়া দেয়, বলে ওর বাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
স্কুল… বাস…বন্ধুত্ব.. একচটকায় উত্তরটা মাথায় এল,
” বন্ধুত্ব হল এমন এক সম্পর্ক যা জীবনে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়”।
ছোট ছেলেটি ঘোর বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে।
আমারও তো বন্ধু ছিল, হ্যাঁ।
আজ আর নেই।
কিন্তু একদিন ছিল।
গরমের ছুটিতে দাপাদাপি করতাম তার সাথে।
সকাল হলেই সাইকেল নিয়ে মাঠে ছুট।
বিকাল হলেই সবার জমায়েত।
…
জীবনটাই অন্য ছিল।
ছেলে হাতে টান মারে, বলে, ” তোমার বন্ধুরা কই আব্বু?”
মনে পড়ে কষ্টের কথা। আজ বহু বছর, তাদেরকে দেখিনা।
ছোটবেলার বন্ধুত্বের প্রকৃতি বড়বেলায় যে এভাবে বদলাবে বুঝতে পারিনি।
শেষে বুঝতে পারতাম, ওরা এড়িয়ে যাচ্ছে আমাকে।
ওরা আর ডাকত না, আমিও যেতাম না আর।
সবটা যেন স্কুল থেকেই আলাদা হয়ে গেল।
ইগো আর দম্ভের মাঝখানে আমার বন্ধুগুলো হারিয়ে গেল।
তার উপর নতুন ঝামেলা।
রাজনীতি আর ধর্ম।
সবটা মিলে চারপাশের পরিবেশ যেন দমবন্ধ করে দিল আমার।
একুশ বছরের বন্ধুত্ব ভাঙতে কষ্ট হয়েছিল সেদিন।
কিন্তু না ভেঙে উপায়ও ছিল না।
তারপর অনেক ঝড়ঝাপটা সামলে আজ চাকরি করি।
ছেলেকে ভালোবাসি, বউকে ভালোবাসি।
মাকে ভালোবাসি, ভাইকে ভালোবাসি।
শুধু বন্ধুদের আর ভালোবাসা হয় না।
হয়তো ওরা হারিয়ে গেছে…এটাই ভাবতাম।
চেষ্টা করিনি, ওরাও করেনি। অভিযোগ ছিল, এখন তাও নেই।
পোড়া কপাল আমার, বন্ধু পেয়েও হারিয়েছিলাম।
দোষ তো আমার ছিল না, তবু শাস্তি পেতে হয়েছিল সেদিন।
চারদিকে আগুনের মাঝেই, কী ভাবে প্রান বাঁচিয়ে ফিরি সেটাই ছিল ভাবার বিষয়।
বাড়ি ছেড়ে বেরোনোর আগে ওদের দেখি।
ওদের… ওই তো ওরা, মাথায় তিলক হাতে তলোয়ার তা থেকে পড়া রক্ত !
আমার ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়।
দেরি করিনি তাই পালিয়েছিলাম।
আর ফিরিনি।
বহু বছর কাটল, তাও ফিরিনি।
এখন শুনি নতুন করে বাসন্তী পুজো হয় সেখানে।
মনে পড়ে ক্লাস ইলেভেনের টেস্ট পরীক্ষার সময়ে পুজো ছিল।
তাতে কী, বন্ধুদের অভয়বাণী শুনে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলাম।
হ্যাঁ কষ্ট হয়, সবটা মনে পড়ে।
বেশি করে মনে পড়ে আমার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের কথা,
হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্বের কথা…
তবু বলব, হাল ছাড়ব না।
বন্ধু যদি সত্যি হয়,
তার সামনে হাত পাততে দোষ কোথা?
হাত পাতব, তার বন্ধুত্বের জন্য, বলব,
চল না আরেকবার সাইকেল নিয়ে ঠাকুরটা দেখে আসি।
না হয়, আজ হিংসা তোলা থাক, ইগোটা ছুটিতে যাক।
শুধু তুই আর আমি বেরোই।