রত্ন যদি অতলে যায় “নৌকাডুবি”র সাথে তবে বাঁচাব কেমনে?
মনসাগরে ডুব দিলে রত্ন পাওয়া যায় তবে সে যদি নিজের প্রাপ্য না হয়? যদি সে রত্ন নিহাত পরিহাসচ্ছলে ভাগ্যবিধাতা হাতে তুলে দেন? তবে দোষ কার? ভাগ্যবিধাতা নাকি প্রাপকের?
ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘নৌকাডুবি’ দেখতে দেখতে বারবার কমলার অবস্থার কথা ভেবে এটাই মনে হয়েছে। নববধূর অচেনা ভাগ্য যখন বিধাতার নিদারুণ পরিহাসে আকস্মিক বিদ্ধ হয়ে ছটফট করে, তখন যেন বিবাহ আর সুখ রত্ন দুটোই অমূলক হয়ে যায়।
ঋতুপর্ণ ঘোষ বারবার নারী চরিত্রকে বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রূপে উত্থাপন করেছেন। হেমনলিনীকেই ধরা যাক, রমেশের সাথে ভাগ্যের মিলন হতে তার দেরি আছে, তবে সেও তো অসহায়। প্রেম রত্ন পাবার আশায় মাথা কুঁটেছে আজীবন। এ বিভীষিকা কী শুধু নারীদের প্রাপ্য?
রমেশ হল সবথেকে উৎকৃষ্ট উদাহরণ, ভাগ্যের পরিহাসের। যে সমাজের চাপে সে সুশীলাকে গ্রহণ করল। সেই ভাগ্যবিধাতাই, সুশীলাকে কেড়ে তার জায়গাতে কমলাকে রমেশের পাশে টুক্ করে বসিয়ে দিলেন। এ কী তার দোষ? কমলার প্রকৃত স্বামীর খোঁজে সে ঘুরে মরেছে, কমলার শরীরের যথাযথ খেয়াল রেখেছে, তবু একটা দিনের তরেও সে অধিকার ফলায়নি। এ রত্ন দুর্লভ হে।
মনের ভাবের ক্ষেত্রে এ সমাজ অনেক দুর্বিষহ এবং অত্যন্ত নিরুদ্বেগ। নলিনাক্ষ যেন তারই প্রতিরুপ। কমলাকে না পাওয়াতে তার আঘাত লাগলেও ক্ষত নেই, হেমনলিনীকে গ্রহণ করতে তার বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই, হেমনলিনী তাকে ফিরিয়ে দিলেও তার খুব বেশি কষ্ট নেই আবার কমলা ফিরে আসাতেও তার মন সমান নিরুদ্বেগ। মনের অনুভব রত্ন সমাজ যেন তার মধ্যে থেকে পুরোটা শুষে নিয়েছে।
আর কমলা? কষ্ট হয়। শেষে যখন রমেশ তাকে দেখতে আসে নলিনাক্ষ আর তার নব সংসারে তখন সে ছলছল চোখে জানায় সত্যি আর মিথ্যের প্রভেদ সে জানে না। যাকে সে গ্রহণ করল, নিষ্পাপ মনে তাকেই ভাগ্যবিধাতা ভুল প্রমাণ করাল। তাই ভাগ্য ফেরে শ্রীকান্ত আচার্যের গলায় বেজে চলে,”তরী আমার ডুবে যায়…”…
রত্ন যদি হাতছাড়া হয় নিষ্ঠুর পরিহাসে তবে সে যে আর মেলে না, কয়েকটা অজানা সম্পর্ক গড়ে ওঠে শুধু সবার অগোচরে, অলক্ষ্যে।
মন অতলে যায় “নৌকাডুবি”র সাথে তবে ভাগ্যের পরিহাসের আঘাত লাগলেও ক্ষত নেই।