‘প্রাক্তন’ নামটার সাথে আমরা সকলেই প্রায় অল্প বিস্তর পরিচিত। প্রাক্তন নামটা শুনলেই বাঙালিদের বুকে শান্ত অথচ বেদনাদায়ক একটা ঝড় আসা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু না। আর এই বেদনাটাকে কাজে লাগিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে ২০১৯ সালে রিলিজ করে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় পরিচালিত সিনেমা ‘প্রাক্তন’।
সিনেমাটিতা অভিনয় করতে দেখা গেছে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় (উজান), ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত (সুদীপা), অপারিজাতা আঢ্য( মালিনী / মলি), বিশ্বনাথ বসু (অজয়), মানালি দে, সাবিত্রি চট্টোপাধ্যয়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যয়, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যয়, সুরজিৎ চ্যাটার্জী
সিনেমাটিকে গতি দিয়েছে আমাদের কবিগুরু রবিঠাকুরের কবিতা ‘হঠাৎ দেখা’। যার শুরুতেই বলা হয়েছে – “রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।”
অতএব বোঝায় যাচ্ছে যে যা চিত্রনাট্য রয়েছে সিনেমাতে তা একটা রেলগাড়ির কামরার আশেপাশেই ঘোরাঘোরি করছে। আর এই সিনেমার সবথেকে চমকপ্রদ আর একটি বিষয় হলো যে এই কবিতাটি আমাদের শ্রদ্ধেয় শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
ওনার গলাতে কবিতা টি যেনো আলাদা একটা মাত্রা পেয়েছে।
সিনেমার গল্পটি খুব সাধারণ। আর সাধারণ বলেই হয়তো একটা গোটা বাঙালি জাতি নিজেকে মেলাতে পেরেছে সিনেমাটির সাথে। একটা রেলগাড়ির কামরা যেখানে মোট তিনটি দম্পতি দেখা গেছে যারা দাম্পত্য জীবনের তিনটি ভিন্ন পর্যায়কে বিবৃত করে।
প্রথম পর্যায় মানে বিবাহের একদম শুরুর দিক যেখে রোমান্টিকতা, কিছুটা ছেলেমানুষি আর অনেকটা ভালোবাসা।আর এই প্রথম পর্যায়ের দম্পতির ভুমিকাতে অভিনয় করেছেন, বিশ্বনাথ বসু (অজয়) ও মানালি দে।
তৃতীয় পর্যায়, যেখানে দম্পতি তাদের দাম্পত্য জীবনের অনেকটা সময় একসাথে কটিয়ে এসেছেন। যারা জীবনের প্রায় শেষ বয়সে এসে ঠেকেছে। যেখানে শুধুই নিখাদ ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধের চরমতম দিকটা উপোভোগ করা যায়।
আর এই পর্যায়ে অভিনয় করেছে আমাদের কিংবদন্তীগন সাবিত্রি চট্টোপাধ্যয় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যয়। আর মনে হয় না এই ভুমিকাতে এানদের থেকে ভালো অভিনয় কেউ করতে পারতেন।
এই বার আসি দ্বিতীয় পর্যায় বা দাম্পত্য জীবনের ঠিক মধ্যবর্তী পর্যায়। এই পর্যাটিকে শেষে বলার কারন হচ্ছে যে সবথেকে জটিল পর্যায় হলো এই মধ্যবর্তী পর্যায়। এখনেই বেশির ভাগ সম্পর্ক ছোটো-খাটো ভুল বোঝাবোঝির জন্য ভেঙে যায়, আবার যদি দু’জনের মধ্যে ঠিকমতো বোঝাপড়ার দরুন সম্পর্ক এগিয়ে তৃতীয় পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যায়। এই পর্যায়ে দায়িত্ব বোধ লক্ষ করা যায়, যেখানে সংসারের চাপে ও সন্তানদের মানুষ করার চাপে সচরাচর ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলা হয়ে ওঠে না ঠিকই কিন্তু তাবলে ভালোবাসার পরিমানটাও কমেনা বরং বাড়ে শুধু ব্যাস্ত জীবনের মেঘে ঢাকা পড়ে যায় বা কিছুক্ষনের জন্য লুকিয়ে যায়। সিনেমাটিতে কবিগুরু ‘হাঠৎ দেখা’ কবিতার একটা সুন্দর লাইন বলা আছে-
‘রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।’
এই লাইনটা হয়তো এই বিষটিকেই বিবৃত করে।
আর এই পর্যায়ে দম্পতির ভুমিকাতে অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় (উজান), ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত (সুদীপা), অপারিজাতা আঢ্য( মালিনী / মলি)।
একটা মেয়ে যে বাইরে থেকে কোলকাতা ঘুরতে এসেছে, একটা ছেলে যে কোলকাতাটাকে একটা অন্যরুপ দিয়ে সেই মেয়েটির কাছে তুলে ধরে। মেয়েটি কোলকাতার সাথে সাথে সেই ছেলেটির প্রেমে পড়ে। অনেক কিছুরই তোয়াক্কা না করে তারা বিয়ে করে। বিয়ের পর শুরু হয় তাদের মধ্যে ছোটো ছোটো বিষয় নিয়ে ঝামেলা। যা বিবাহ বিচ্ছদের রুপ নেয় এবং তার পর সব শেষ।
ছেলেটি কোলকাতা তেই থাকে কিন্তু মেয়েটি ফিরে যায় তার বাড়ি।
বহু বছর পর তাদের আবার দেখা, ভিন্ন ভাবে ভিন্ন জায়গায়। কিন্তু এতোদিনে অনেক কিছুই বদলে গেছে, তারা দু’জনই অনেকটা এগিয়ে গেছে। তারা আবার বিয়ে করেছে। বদলে গেছে মুখের আদল, শুধু বদলাই নি তাদের সেই ভালোবাসাটা যেটা তারার মতো আবার কোথাও দিনের আলোতে লুকিয়ে গেছে। তারা এতোদিনে এইটা বুঝে গেছলো যে, কিছু ভুল হলে সেটাকে মিটিয়ে এগিয়ে যাওয়াটাই ভালো ছেড়ে যাওয়সর থেকে। তাদের সবকিছুই আছে, হয়তো কোথাও যেনো তারা এখোনো একে অপরকে ভালোবাসে, নেই শুধু আর আগের মতো অধিকার।
শেষে পর পর দুটো চমক দিয়ে সিনেমাটি শেষ হয়।
প্রথম চমকটি দেয়, উজানের স্ত্রী মলি বা অপারিজাতা আঢ্য। এবং দ্বিতীয় চমক দেয় সুদিপার স্বামী শাশ্বত চ্যাটার্জী, যাকে খুবই অল্প সময়ের জন্য দেখা গেলেও চরিত্রটি ভালো প্রভাব ফেলেছে সিনেমাটিতে।
এ তো হলো সিনেমার কথা, এবার আসি গানের প্রসঙ্গে। সিনেমাটির প্রতিটি গানই একটা ভারি অনুভূতি বহন করে। সুরকার অনুপম রায়ের কাজ আগেও আমরা দেখেছি কিন্তু এই সিনেমাতে তার কাজ গোটা বাঙালি জাতি আজীবন মনে রাখবেন। এছাড়াও এই গানের দিকটি নজরে রেখে সিনেমার মধ্যেও একটি গানের বিশেষ দলকে দেখানো হয়েছে যেখানে সুরজিৎ চ্যাটার্জী, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় ও উপাল সেনগুপ্তকে দেখা গেছে।
সব কিছু মিলিয়ে সিনেমাটি অনবদ্য। সেটা অভিনয়ের দিক থেকেই হোক বা গানের দিক থেকেই হোক।