অনেক ধরনের তো চিত্র দেখছেন,’রক্তাক্ত চিত্র’ দেখেছেন কোনোদিন? চলুন আজ আপনাদের একটা গল্প বলি। দাদুর মুখ থেকে শোনা হড়হিম করা গল্পের মধ্যে এটা একটা। সবথেকে ভালো জিনিস যে শল্পী নিজেই গল্পটা বলেছেন। চলুন শুরু করা যাক তাহলে ‘ রক্তাক্ত চিত্র’।
সকাল থেকে আজ খুব ব্যস্ত আমি। সব কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে নিচ্ছি কারণ রাত্রে বেলায় আজ বেরিয়ে পড়তে হবে আর এক নতুন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।
আমি একজন চিত্রশিল্পী। পরিবেশে ঘটে যাওয়া নিত্যদিনের বিভিন্ন ঘটনাকে আমার নিখুঁত শৈল্পিক ভাবনা দিয়ে চিত্রিত করাই হলো আমার কাজ। আর এই কাজের জন্য আমি যেকোনো ধরণের বাধা অতিক্রম করতে পারি। এই জগতে আমার কোনো কিছুর প্রতি মায়া নেই, নিজের সৃষ্টি বাদে। আমার দ্বারা সৃষ্টি হওয়া প্রায় প্রতিটি চিত্র লক্ষ লক্ষ টাকা দাম দিয়ে মানুষ কিনতে চায়। কিন্তু আমি বিক্রি করি না। কারণ আমার সৃষ্টি আমার কাছে মূল্যহীন। শুধু একদিন সময় করে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করি তাতে আমার চিত্র গুলো মানুষের সামনে তুলে ধরি, এবং প্রদর্শনী শেষে সমস্ত চিত্রদের আবার বাড়ি নিয়ে চলে আসি। আমি বরাবর একটু অন্য ধরণের চিত্র আঁকি। মানুষ যা আঁকে সাধারণত আমি তা আঁকি না। মানুষ যা আঁকতে চাই না, আমি তাই আঁকি।
যায় হোক, সময় হয়ে এলো বেরিয়ে পড়বার। আজ আমার ইচ্ছে একটা জ্বলন্ত চিতা আঁকার। একটা শরির পুড়ে যাওয়াটাকে আমি ক্যাভাসে আটকে রাখতে চায়। কিন্তু শহরের কোলাহল পূর্ণ শ্মশানে শান্তিতে আঁকা সম্ভব না আর তাই অনেক খোঁজা খোঁজি করে শহর থেকে দুরে একটা ফাকা নদীর ধারের সন্ধান পেয়েছি যেখানে পাশের গ্রামের মানুষরা মৃতদেহ দাহ করে, এবং আজও একটা লাশ দাহ করার আয়োজন চলছে। তাই আর দেরি না করে পৌছে গেলাম। লাশটা চিতাতে একটু একটু করে পুড়ছে আর আমার ক্যানভাস নতুন সৃষ্টিতে আলোকিত হচ্ছে। আশে পাশে আত্মিয় পরিজন বলতে তেমন কেউ নেই শুধু কিছু সাধু আছেন তাই আমি বেশ কিছুটা দুর থেকেই সমস্তটা ক্যানভাসে তুলতে মত্ত হয়ে পড়েছিলাম। এমন সময় হঠাৎ আমার কাঁধে একটা ঠান্ডা হতের স্পর্শ অনুভব করলাম এবং আমার ঘোর কাটলো। আমি পিছন ফিরে তাকালাম, অন্ধকারে স্পস্ট তাকে দেখতে পেলাম না শুধু একটা ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারলাম।
– নমস্কার, আপনি কি সেই বিখ্যাত চিত্রশিল্পী রন বাবু?
– বিখ্যাত কিনা জানি না তবে আমিই চিত্রশিল্পী রন কিন্তু আপনি কে?
– আমি এই পাশেই থাকি, একটু আধটু তন্ত্র সাধনা করি।
– তা আপনি আমাকে চিনতে পারলেন কি ভাবে?
– একজন প্রকৃত সাধকই তো আর একজন প্রকৃত সাধককে চিনতে পারে। যদিও আমাদের সাধনা ভিন্ন ভিন্ন।
রন বাবু, আমি জানি আপনি একটু অন্যরকমের মানুষ। তাই আপনার জন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি আজ। এই প্রস্তাব আপনার সৃষ্টি ভান্ডারকে এক নতুন মাত্রা দিতে পরবে বলে আমার মনে হয়।
– কি প্রস্তাব?
– আপনি তো আপনার শৈল্পিক ভাবনা দিয়ে অনেক চিত্রই তুলে ধরেছেন, কিন্তু আপনি কোনোদিন রক্ত দিয়ে চিত্র সৃষ্টি কি করতে পেরেছেন?
– গাঁঞ্জিকা সেবনটা ভালোই চলে মনে হয়। এখন আপনি যান আমাকে আঁকতে দিন।
-আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু ভেবে দেখবেন একবার।
সে চলে গেলো। সাথে সাথে আমার মুডটা বিগড়ে দিয়ে গেলো। বুঝে গেলাম যে আজ আর আঁকা হবে না। এতো আয়োজন সকাল থেকে পুরোটা ভেস্তে গেলো। তাই সবকিছু গুটিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। গোটা রাস্তা তার বলা একটা কথা আমাকে শান্তি দিচ্ছিলো না। বার বার কানে বাজছিলো “কোনোদিন রক্ত দিয়ে চিত্র সৃষ্টি কি করতে পেরেছে?” মনে হচ্ছিলো সে যেন আমার দিকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চাইলো।
বাড়ি এসে গোটা রাত আমার ঘুম আসে নি। তার পরের দিন আমি কোনো কাজে মনও বসাতে পারিনি। তাই ভাবলাম আজ রাত্রে আবার যাবো সেখানে।
আজ আবার প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছে। কোনোরকমে পৌছালাম সেখানে ছাতা নিয়ে। কেউ কোথাও নেই ভেবে চলে আসবো এমন সময় পিছনে থেকে দেখি আওয়াজ এলো।
– আমি জানতাম রন বাবু আপনি আসবেন। সাধক মানুষ তো, সর্বদা নতুন সাধনার খোঁজে থাকে।
– আপনি কালকে কি বলছিলেন বলুন।
– নিশ্চই, আমি আমার তন্ত্র সাধনা দিয়ে আপনাকে একটা আলৌকিক শক্তি দেবো, যার দ্বারা আপনি আপনার শরীর থেকে সাময়িক ভাবে আপনার আত্মাকে বের করতে পারবেন। এবং তারপর আপনি আমার বলা মানুষদের খুন করে তাদের রক্ত সংগ্রহ করে নিয়ে আসবেন, তারপর পুনরায় আপনার শরীরে প্রবেশ করে সেই রক্ত দিয়ে চিত্র অঙ্কন করবেন।
পুরো ব্যাপারটা শুনে আমি কিছু বলার মতো অবস্থায় ছিলাম না। আমি? খুন?
– না না আমি এইসব খুন-তুন করতে পারবো না।
– আপনাকে সন্ন্যাসীদের মারতে বলা হয় নি। আপনি যাদের মারবেন তারা সবাই সমাজের দুর্নীতিগ্রস্ত বা অপরাধী মানুষ। তাদেরকে মেরে আপনি সমাজের কল্যানই করবেন পরোক্ষভাবে। আর একজন শিল্পীর কাছে সব থেকে বড়ো মায়া শুধুমাত্র তার সৃষ্টি অন্যকিছুই না। কি তাইতো?
আমি রাজি হয়ে গেলাম। জীবনে অনেক রকমের বাধা অতিক্রম করে অনেক কিছুই চিত্র এঁকেছি কিন্তু কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত বা অপরাধী মানুষের রক্ত দিয়ে কোনো কিছু আঁকিনি। তাই নতুন ধরনের সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আমি নিজে কোনোরকমের আর বাধা সৃষ্টি করলাম না।
তার বলা সময়ে আমি সেই নদির কাছে তার ঠিকানাতে পৌছে যেতাম এবং সে আমাকে এক একজন মানুষের নাম ঠিকানা দিতো সাথে তার তন্ত্র সাধনার বলে আমার আত্মাকে আমার দেহ থেকে বার করতো। আমি আমার দেহকে এক পাশে তার কাছে তার দায়িত্বে ছেড়ে খুনগুলো করে সেই সব মানুষদের রক্ত সাথে করে নিয়ে আসতাম এবং সেই রক্ত দিয়েই সৃষ্টি করতাম নতুন নতুন সব চিত্রশিল্প। ধীরে ধীরে আমারও কেমন যেন রক্তের নেশা হয়ে গেছলো। আমিও রক্ত দিয়ে ছবি আঁকতে মত্ত হয়ে পড়েছিলাম। সব কিছু ঠিকই চলছিলো। হঠাৎ একদিন সে প্রতিদিনের মতো তার তন্ত্র সাধনার বলে আমার শরীর থেকে আমার আত্মাকে বার করে এবং একজনের নাম ও ঠিকানা দেয়।
– রন বাবু, এই কাজটা একটু কঠিন হবে কিন্তু আপনাকে পারতেই হবে। এই নিন, এতে নাম দেওয়া আছে।
– আর ঠিকানা?
-আপনি জানেন।
আমি কাগজটা খুলে নামটা দেখতেই আমার পায়ের তলায় মাটি সরে গেলো। এটাতো আমার বাবার নাম!
আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন থেকেই আমার মা এবং বাবার মধ্যে তুমুল ঝগড়া দেখেছি। প্রায়দিনই আমার বাবা মদ খেয়ে বাড়ি আসতো এবং মা এর সাথে ঝগড়া করতো।
তখন আমার বয়স বারো। একদিন বাবা মদ খেয়ে মা কে সজরে ধাক্কা দেয়, মা কল তলাতে পড়ে যায় এবং মাথাটা সজরে কলের সাথে লাগে, মা- এর শরিরটা কাঁপতে কাপঁতে ঠান্ডা হয়ে যায়। আমি প্রচুর কেঁদেছিলাম। বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, বাবার মুখ দেখে বুঝেছিলাম বাবাও কষ্ট পেয়েছে মদের নেশায় তার হাতে যে পাপটা হয়েছিলো তার জন্য সে অনুতপ্ত। কিম্তু তবুও সেই দিনের পর থেকে আমি আর বাবার সাথে কোনো রকমের সম্পর্ক রাখিনি।
আমি জানি বাবা একটা জঘন্য কাজ করেছে আর তার জন্য সবথেকে বড়ো ক্ষতিটা আমারই হয়েছে কিন্তু তা বলে আমি বাবাকে মারতে পারবো না। হঠাৎ করে আমার এই রক্ত দিয়ে আঁকার নেশাটাও কেমন যেন কেটে গেলো। মনে মনে ভাবলাম যে আমিও এতো দিন যা করছি সেই গুলোও তো ভুল। যে যতোই খারাপ হোক তার শাশ্তি দেওয়ার জন্য দেশে আইন আছে। আমি কেউ নয়। আমি তাকে বলে দিলাম যে আমি পারবো না এই কাজটা করতে এবং এই ধরনের আর কোনো রকমের কাজ করতে।
– দেখুন রন বাবু, আপনি এতোদিন যা করেছেন সবই আমার ইচ্ছাতে, আপনার নয়। আপনি যদি সেইদিন রাজি না হতেন তাহলে আমি আপনার কাছে পৌছে সবার আগে আপনাকে মারতাম তারপর আপনার আত্মাকে বন্দি করে এই কাজ গুলো করাতাম। আজ যদি আপনি এই কাজটা না করেন তাহলে আপনার এই যে দেহটা আমার কাছেই এখন, আমি গলাতে একটা ব্লেড চালাবো এবং শেষ করে দেবো এই দেহ, আপনি আর কোনোদিন এই দেহে প্রবেশ করতে পারবেন না।
– না না দয়া করে এমনটা করবেন না, আমি তো আপনার কিছু করিনি। আপনি আমার এতো বড়ো ক্ষতিটা করবেন না প্লিজ।
সে ব্লেড বার করে আমার নিথর শরীরের গলাতে চালাতে যাবে এমন সময় দেখি কিছু মন্ত্র ভেসে আসলো। কিছু সাধু আমাদের দিকে কি সব মন্ত্র পড়তে পড়তে আসছে, এবং সে যেনো যন্ত্রনায় কাতর হয়ে পড়ছে। সেই সাধুগুলো সামনে আসতেই লক্ষ করলাম যে তারা সেইদিন চিতার পাশে ছিলো।
ধীরে ধীরে দেখলাম যে সে ছাই হয়ে উড়ে গেলো।
আমার আত্মাটা সে ছাড়া কেউ দেখতে পেতো না, কিন্তু অবাক রকম ভাবে এই সমস্ত সাধুগুলো আমাকে দেখতে পেলো এবং প্রথমে আমাকে আামার শরীরে প্রবেশ করাবার ব্যাবস্থা করে দিলো। আমি স্বাভাবিক অবস্থাতে আসতেই তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-আপনারা কে, আর এই গুলো কি হচ্ছে?
-আমরা সকলেই মা এর সাধনা করি বাবা। আর আমাদের সাথে সাধনা করতো ত্রিলোকনাথ, কিন্তু তার সাধনা করার লক্ষই ছিলো অশান্তির পথে পৃথিবী জয় করা, সে আসতে আসতে লোভের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলো এবং একদিন এক বিরল এবং কঠিন সাধনা করতে গিয়ে সে মারা যায়। আমরা সেই দিন তারই দেহ দাহ করছিলাম। আমরা তোমাকে লক্ষ করেছিলাম কিন্তু ভাবিনি ত্রিলোকনাথ মৃত্যুর পরে এমনটা করবে। যাই হোক, সে আর তোমাকে কিছু করতে পারবে না, আমরা তার ব্যবস্থা করবো। তুমি এই জায়গা ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যাও বাবা। আর কোনো দিন ফিরে আসো না।
আমি তাদের সকলকে প্রনাম করে ওই জায়গা ছেড়ে চলে আসি। এবং পরের দিন সকালে থানাতে গিয়ে সমস্ত খুনের জন্য নিজেকে আত্মসমর্পন করি।
সমাজে যে যতোই খারাপ কাজ করুক তার জন্য আইন আছে আর সবথেকে বড়ো বিচারক সৃষ্টি কর্তা, আমরদের কারো অধিকার নেই কারো জীবন নেওয়ার। আমি গোটা জীবন চিত্র অংকন করবো কিন্তু সৎ পথে। এিলোকনাথও আর কোনোদিন ফিরে আসে নি।