হোটেলের এই রুমটাতে ঢুকে ভারী পছন্দ হয়ে গেলো সুজাতার। পুরনো দিনের সুদৃশ্য বিশাল খাট, পুরনো দিনের আলমারি, পেন্ডুলাম ঘড়ি, বেশ আগেকার দিনের মতো ফিলিং পুরো রুম জুড়ে। আর সবচেয়ে যেটা সুজাতাকে আকর্ষণ করলো সেটি খাটের পাশের দেওয়ালে টাঙানো এক অপরূপ নারীর ছবি। ফর্সা দেবীপ্রতিমার মত মুখখানি, কাজল টানা মায়ায় ভরা চোখ, ঠোঁটের কোণে আলগা হাসি। মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়েছিল সুজাতা।
“এই হোটেলের মালকিনের ছবি।” পেছন থেকে হোটেলের ম্যানেজার সুভাষবাবু বললেন। “কি অপূর্ব দেখতে!” “ওনার এই রুম টা সবচেয়ে পছন্দের ছিল, তাই উনি মারা যাওয়ার পর ওনার স্বামী এখানে ওনার একটা ছবি রেখে গেছেন।” “ওনার স্বামী এখানে থাকে?” “না মানে আসলে মালকিনের চলে যাওয়াটা একটু অদ্ভুত প্রকৃতির ছিল, উনি চলে যাওয়ার পর ওনার স্বামী এখানে থাকতে চাননি। দেহরাদুনেরে কাছে ওনার একটা বাড়ি আছে। ওখানেই থাকেন। মাসে একবার আসেন সব দেখতে।” “অদ্ভুত প্রকৃতির! মানে?” সুভাষবাবু আর কিছু বলার আগেই সুজাতার হাজবেন্ড অনিক বলে, “উফ্! রুমে ঢোকার পর থেকেই তোমার প্রশ্ন দেখি শেষ হয় না! আর কোনো কথা নয় এখন, ফ্রেশ হয়ে নাও, সেই কাল থেকে জার্নি হচ্ছে।”
সাত বছরের প্রেম সুজাতা আর অনিকের। বিয়ের পর সুজাতার আবদারে পাহাড়ে হানিমুনে এসেছে ওরা। কিন্তু আগের থেকে বুকিং ছিল না তাই হোটেল পেতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো। অবশেষে শহর ছাড়িয়ে একদম শেষ মাথায় পুরনো ধাঁচের এই হোটেলটা চোখে পড়লো অনিকের। বাইরে থেকে পুরনো মনে হলেও ভেতরটা বেশ পরিষ্কার। ম্যানেজার এই 203 নম্বর ঘরটাই দেখায় আর সুজাতার পছন্দও হয়ে যায়। কিন্তু অনিক লক্ষ্য করেছে সুভাষবাবু লোকটা এমনি ভালো কিন্তু চাহনি টা কেমন কেমন, বিশেষ করে চোখ দুটো। কেমন যেন স্থির! তাকালেই কেমন একটা অস্বস্তি হয়। যাই হোক এমনি সারাদিন জার্নিতে দুজনেই ক্লান্ত, তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পড়লো দুজনে।
ঘড়িতে ক’টা বাজে খেয়াল নেই, সুজাতার আর্ত চিৎকারে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে অনিক! “কি হলো কি হলো! দাঁড়াও লাইট জ্বালাই।” লাইট অন করে সুজাতাকে দেখে ভয়ে কেঁপে উঠলো অনিক! সুজাতার গলায় কালশিটে দাগ! যেনো কেউ গলা টিপে ধরেছিলো! যন্ত্রণায় ককিয়েঁ উঠছে সুজাতা! “এ কী! তোমার এই অবস্থা কি করে? তুমি.. তুমি ঠিক আছো?” “আ..আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম, হঠাৎ দেখি গলার কাছে অসহ্য ব্যাথা! আর কিছু ভাবতে পারছিনা!” সুজাতাকে বুকে টেনে নেয় অনিক। “কিচ্ছু হবে না, আমি আছি তো, দাঁড়াও দেখছি।” সুজাতাকে জল খাওয়ালো অনিক। “তুমি বসো আমি একটু দেখে আসছি, ভয় পেও না।” দরজা খুলে বাইরে আসে অনিক। করিডোর টা ভালো করে ঘুরে দেখে। হঠাৎ সুজাতার চিৎকার শুনতে পায় অনিক! দৌড়ে ঘরে এসে যা দেখে তাতে অনিকের শরীর হিম হয়ে আসে! পুরো ঘর লন্ডভন্ড! খাটের এক কোনায় সুজাতা বসে কাঁদছে, পরনের রাত পোশাকটা ছিন্নভিন্ন! নাহ্ আর এক মুহুর্ত এখানে থাকবেনা অনিক। কিছু একটা গন্ডগোল তো আছেই! ওই ম্যানেজারের চোখটাও কেমন একটা…। সুজাতাকে ওঠায় অনিক, কিন্তু এ কী! এবার শুধু গলায় নয়, হাতে, ঘাড়ে সব জায়গায় কালশিটে দাগ! “আর এখানে আমরা থাকবনা, চলো এক্ষুনি, বাকি রাতটা বাইরে কাটিয়ে দেবো।” সুজাতার গায় চাদর জড়িয়ে সবে ওকে নিয়ে বেরোতে যাবে অনিক, তখনি আওয়াজ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল! আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরের লাইটত নিভে গেল! আতঙ্কে সুজাতা খামচে ধরেছে অনিককে। হঠাৎ গোটা ঘর জুড়ে বিকট মহিলার গলায় অট্টহাসি! উফ্! সে যে কি ভয়ানক গলা! ভয়ে, আতঙ্কে কি করবে বুঝে পায়না অনিক। সুজাতা বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেছে! বিছানায় সুজাতাকে শুইয়ে দরজার কাছে গেলো অনিক। বেরোতেই হবে, যে করেই হোক, এই ভুতুড়ে জায়গা থেকে বেরোতেই হবে। প্রাণপণে দরজায় ধাক্কা মারতে লাগলো অনিক। হঠাৎ পেছনে কিসের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দাঁড়ায় অনিক, আর ঘুরে দাঁড়াতেই পায়ের তলার মাটি যেনো নড়ে উঠলো! সেই ছবির মহিলাটা না! হ্যাঁ তাই তো! সেই মহিলা! কিন্তু উনি তো.. ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে যায় অনিকের। ছবি ফাঁকা! সেই মুখটা নেই! নিজেকে পাগল মনে হলো অনিকের। মাথা ঘুরে উঠলো অনিকের। ধপ করে পড়ে গেলো মেঝেতে!
চোখ খুলেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসে অনিক। আরে আস্তে আস্তে, ডাক্তার আপনাকে রেস্ট নিতে বলেছেন।” চারিদিকে চেয়ে দেখে অনিক।”আমি কোথায়? আর সুজাতা? সুজাতা কই?” “চিন্তা নেই, আপনার স্ত্রী পাশের ঘরে, আমার স্ত্রী আছে ওনার কাছে, উনি ঠিক আছেন। আমি এই হোটেলের ম্যানেজার, অলোক দাস। কাল রাতে আমার ছুটি ছিল। আজ সকালে এসে দেখি আপনারা দুজন করিডোরে পড়ে আছেন! দেখেই আমি আপনাদের আমার রেস্ট রুমে নিয়ে আসি। আপনারা কি কালকে এসেছেন? কিন্তু ওভাবে করিডোরে আপনারা.. কি হয়েছিলো?”
ধীরে ধীরে কাল রাতের সমস্ত কথা খুলে বলে অনিক। সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন অলোকবাবু। “আমারই ভুল! রাতের বেলা আমি এখানেই থাকি। কালকেই.. আসলে কাল আমার স্ত্রীর জন্মদিন ছিল তাই আমি বাড়িতে ছিলাম। কাছেই আমার ঘর। কেয়ারটেকার সবং কে রেখে গেছিলাম। কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে কাল সবং নির্ঘাত চুল্লু খেয়ে ওর ঘরে পড়ে ছিলো! ওকে পরে আমি দেখছি। সরি অনিকবাবু আমার জন্যই আপনাদেরএই অবস্থা।” “কি ব্যাপার বলুন তো? এই হোটেলের কি কিছু…”। “ঠিক ই ধরেছেন, আসলে কাল যে ছবি আপনারা দেখেছেন উনি এই হোটেলের মালকিন রাইমা মিত্র। অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন। ওই 203 নম্বর ঘরটা ওনার সবথেকে পছন্দের ছিল। যখনই আসতেন ওই ঘরে উঠতেন। একদিন সকালে ওনাকে মৃত অবস্থায় ঘরে পাওয়া যায়। কেউ একজন গলা টিপে ওনাকে খুন করেছিলেন! পরে শোনা গেছে ওনার একজন প্রেমিক ছিলেন, যেদিন উনি মারা যান তার আগে ওই প্রেমিকের সাথে ওনার ঝামেলা হয়েছিল। সেইই হয়তো…। ওনার স্বামী বড় ভালো মানুষ ছিলেন। স্ত্রীর চলে যাওয়াটা উনি মেনে নিতে পারেননি। তার কদিন পরেই ওই ঘরেই ওনার ঝুলন্ত দেহ পাওয়া যায়! তারপর থেকেই ওই ঘরে আর কেউ থাকতে পারে না। আপনাদের মত এরম ঘটনা আগেও ঘটেছে। আমি ওই ঘর আর ভাড়াও দিইনা। কিন্তু কালকেই…”
– ওনার স্বামীর নাম কি সুভাষ মিত্র?
কিছু বললেন না অলোকবাবু, শুধু সামান্য হাসলেন।
সেইদিনই সেই অভিশপ্ত হোটেল ছেড়ে দেয় অনিক। সুজাতাকে কিছু জানালো না। শুধু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো আর কোনোদিন পুরনো দেখতে কোনো হোটেলে থাকবেনা!