অ্যা সাকসেসফুল ডেথ
শ্রীজারা ক’মাস হল নতুন বাড়িতে এসেছে, খোদ শহরের বুকেই নিরিবিলিতে গজিয়ে ওঠা একটা দু’কামরার ফ্ল্যাটবাড়ি। শ্রীজার দেশের বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে, আসলে মনটা পড়ে থাকে ওখানেই তাই শুধু মনে পড়ে বললে ভুল হবে! সামনেই উচ্চ মাধ্যমিক, পড়াশোনার চাপ— এসব কারণে পারিবারিক কোনকিছুতেই সে মাথা ঘামায় না ঠিকই তবু কিছু ঘটনা সে মন থেকে মানতে পারেনি আজও। আজও সে খুঁজে চলে তার দাদুর মৃত্যুর রহস্য যদিও দাদুর ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা ছিল ন্যাচারাল ডেথ, কিন্তু সে কিছুতেই যেন এটা বিশ্বাস করতে পারে না। মা-বাবা সরকারী চাকুরে তাই শ্রীজার জন্য তার দাদু আর কাকার ছেলে-মেয়েরাই ছিল সব! বাবা-মা সময় দিতে না পারলেও শ্রীজার দিনগুলো খুব আনন্দে কাটত সেইসময়; হঠাৎ যে কি হল! দাদু মারা গেলেন, তারপরই কাকু নিখোঁজ হলেন, ভাই-বোনেরা চলে গেল তাদের মামারবাড়ি।
তখন সবে দুপুর দুটো, অথচ আকাশের রং দেখে মনে হচ্ছিল সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল বলে! সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছিল সেদিন নাকি বিপদ, নাকি সত্য— সেটা আগে থেকে অনুমান করার ক্ষমতা হয়তো ভগবান ছাড়া কারোরই ছিল না। শ্রীজা পড়ার টেবিলে মাথা গুঁজে তখন অঙ্কের সমাধান বের করার চেষ্টা করছে, ও ভাবতেও পারছে না সেই মুহূর্তে অঙ্কের সমাধান খুঁজতে গিয়ে একটা জীবন-মৃত্যুর সমাধান খুঁজে পেয়ে যাবে! বাইরে বৃষ্টি পড়ছে ভীষণ, মেঘ ডাকছে তারস্বরে, বাড়িতে শ্রীজা বাদে আর কেউ নেই। হঠাৎ মনে হল তার রুমে সে ছাড়া আরো কেউ আছে, যার উপস্থিতি খুব চেনা, আর সেই মুহূর্তে পিছন থেকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করছে বারান্দার কোনায় বসা একটা আরমকেদারা।
শ্রীজা ঘুরে তাকালো ওই চেয়ারটার দিকে এক-দুবার নয় বেশ কয়েকবার যতবার কোনো চেনা উপস্থিতি টের পেয়েছে ঠিক ততবার, কিন্তু কাউকেই দেখতে পায়নি! অনেকক্ষণ ধরে অঙ্ক করার ফলেই হোক বা অন্যান্য চিন্তার কারণে মাথা ঝিমঝিম করছে তার, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই টের পেল তার রুমটা খানিক বদলে গেছে! কিন্তু এ কীকরে সম্ভব! রুমটা পুরো দেশের বাড়ির দাদুর ঘরের মতো লাগছে কেন তার! কিছুই বুঝতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো ঘরের চারদিক। দাদুর কণ্ঠস্বর কানে যেতেই শিউরে উঠলো সে, শুনতে পেল দাদু বলছে, “এটা কিসের ওষুধ বৌমা, খেলে শরীরটা খুব খারাপ লাগে…”; উত্তরে তার মা বলল, “এটা কোষ্টকাঠিন্যের ওষুধ বাবা, না খেলে আরো কষ্ট হবে আপনার”।
শ্রীজার মা তার দাদুকে ওষুধ খাওয়ানোর পর চলে গেলেন, তারপর তার দাদু সেই চেনা স্বরে ডাক দিলেন, “দিদুভাই… ও দিদুভাই…একবার এদিকে এসো তো…”— শ্রীজা এই ডাক শুনে মন্ত্র মুগ্ধের মত দাদুর দিকে এগিয়ে গিয়ে বসল দাদুর পাশে। তারপর শ্রীজার দাদু বলতে লাগলেন এমন কিছু অজানা সত্য যেটা শুনে শ্রীজা নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না!
দাদু তাকে বললেন, “জানো দিদুভাই তোমার মা আমায় কিসের ওষুধ খাওয়ায়?”
— কোষ্টকাঠিন্যের…
— না…
— না? তবে যে…
— তোমার মা যা বলল খানিক ঠিক, তবে খানিক মিথ্যে…
— মিথ্যে! মা মিথ্যে বলবে কেন দাদু?
— কারণ তোমার মা চায় না আমি বেঁচে থাকি…
— কী বলছ দাদু!
— হ্যাঁ, দিদুভাই তোমার মা রোজ কোষ্টকাঠিন্যের ওষুধের সাথে একটু করে বিষ মিশিয়ে দেয়…
— বিষ! মা!
— শোনো দিদুভাই আমি বেঁচে থাকলে সম্পত্তি তোমাদের সবার নামে সমান ভাগ করে দিয়ে যেতাম যেটা তোমার মা চাইতো না, সে চাইতো পুরো সম্পত্তির মালিকানা যাতে তুমিই পাও; তাই প্রতিদিন আমাকে তোমার নাম করে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করতে আরম্ভ করল তোমার মা…
— তারপর?
— তাতেও আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম, তারপর একদিন শুরু হল ভয় দেখানো! আমাকে খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলার হুমকি!
—আমি বিশ্বাস করতে পারছি না দাদু!
— এই দেখো দিদি আমার আসল ডেথ সারটিফিকেট, তোমরা যেটা দেখেছিলে ওটা নকল…
— এবাবা এখানে তো পরিষ্কার লেখা আছে শরীরে বিষক্রিয়ার ফলে মৃত্যু!
— হ্যাঁ! সেদিনও এরকম বৃষ্টি পড়ছিল, তোমার মা অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন সে কারণে; ঠিক সে কারণে নয় আসলে আমাকে মারবার জন্যই। প্রবল বৃষ্টি তুচ্ছ করে এলেন আমাদের ফ্যামিলির উকিলবাবু, তোমার মা’র থেকে মোটা অর্থের বিনিময়ে আমাকে মিথ্যে কথা বলে কিছু সই-সাবুদ করিয়ে নিয়েছিলেন সেদিন।
— এসব সত্যি?
— সব সত্যি দিদি, আমার শরীরটা সেদিন খুব খারাপ থাকায় কিছু না পড়েই সই করে বিদেয় করেছিলাম উকিলবাবুকে, কিন্তু…
— কিন্তু কী?
— কিন্তু এইসব ঘটনা আমার ছোটছেলে মানে তোমার কাকাই কোনোভাবে জানতে পারে, তাই তাকেও খুন করে ফেলে বৌমা; আমি স্বচক্ষে দেখেছি নিজের ছেলেকে খুন হতে!
—খু… ন…
—শরীরে স্লো পয়জনিংয়ের কারণে দিনদিন খুব দূর্বল হয়ে পড়ছিলাম, আর তারপর সেদিন রাতেই…
এই কথাটা শেষের আগেই হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে শ্রীজা দুহাতে মুখ ঢেকে, ঠিক সেই মুহূর্তে কোনো এক চেনা কণ্ঠস্বর তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, ” আমাদের খুনের প্রতিশোধ তুমি নেবে না দিদুভাই?”— এ কথা শোনার পর শ্রীজা কাঠ পুতুলের মত বসে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে চলে যায় ছাদে এমনিতে মন খারাপ হলে ঠিক যেখানে আসে।
সেদিন বিকেলে বৃষ্টি থেমেছে সবে, মস্ত কালো আকাশের নিচে দাঁড়িয়েছিল শ্রীজা, তারপর আস্তে আস্তে উঠল ছাদের কার্নিশে— এমন সময় শুনতে পেল তার মায়ের উৎকণ্ঠার ডাক; শ্রীজা এমনভাবে ঘুরে তাকালো যেন এই ডাকটার জন্যই অপেক্ষা করছিল সে!
ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি এনে শ্রীজা জিজ্ঞাসা করল, ” মা তুমি খুন করেছ, দাদু আর কাকাইকে?” মুহূর্তের মধ্যে তার মায়ের রক্তশুন্য মুখ যেন তাকে আরো পৈশাচিক আনন্দ দিল, শ্রীজা হেসে উঠলো পাগলের মতন আর বলল, ” ও তাহলে আমিই ঠিক!”— কথাটা বলার পরই আর কোনো কিছু না শুনে হাসতে হাসতে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিচের বাগানে…
পরেরদিন খবরের কাগজে বেরিয়েছিল কোনো এক অজানা কারণে এক মা তার নিজের মেয়েকে খুন করেছে ছাদ থেকে ঠিলে ফেলে।
আচ্ছা শ্রীজা কী প্রতিশোধ নিল নাকি প্রতিদান দিল?
– অন্বেষা দে
ছবি : গুগল