এক অন্যরকম সকাল

আজ সকাল থেকেই আকাশটা ভীষণ রকম ভারী হয়ে আছে, চারিদিকে এক অদ্ভুত থমথমে ভাব | রাজের ঘুম ভাঙতে বেশ খানিকটা দেরি হয়েছে আজ | এমনি তে জানলার পাশে খাট বলে, প্রতিদিন ভোরের প্রথম আলোতেই তার ঘুম ভেঙে যায়, তবে আজ আর তা হয়নি | ঘুম যখন ভাঙল তখন প্রায় ১০ টা বেজে গেছে | উঠে সে বুঝল প্রথম হাফের ক্লাসগুলো আর করা সম্ভব নয়, তাই বসেই রইল বিছানায় | সাইড টেবিল থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরাল, সবে মাত্র প্রথম টানটা দিয়েছে, ফোনটা বেজে উঠল | সিগারেট অ্যাস্ট্রেতে নামিয়ে ফোনটা তুলল,

-হ্যালো..

-কি রে, কোথায় তুই ?

-কে? সুমন?

-হ্যাঁ রে, আমি… কোথায় আছিস ?

-বাড়িতে…

-সে কি?? কটা বাজে দেখেছিস ? আসবি না?

-না রে, আজ আর যাব না…

-কেন?

-ভালো নেই রে শরীরটা…

-যাহ, এই তো কাল বললি আসবি… আজ কি হল ?

-ইচ্ছা করছে না…

-আরে ল্যাব আছে তো..

-না আজ আর যাব না…তোরা কর…

-আচ্ছা … রাখলাম…

-হুম..

ফোনটা রেখে অ্যাস্ট্রে দিকে তাকিয়ে দেখে, সিগারেট প্রায় শেষ, শেষ টানটা মেরে, বিছানা থেকে নামল | পায়ে চটি গলিয়ে বাড়ি থেকে বেরোল চা খেতে |

রাজ কলকাতার এক নামি প্রাইভেট কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পরে, একা একটা ঘর নিয়ে থাকে কলেজের কাছেই | নিজে হাতে রান্না করেই খায় তবে সকালের চায়ের জন্যে সে অমলদার দোকানের বাধা কাস্টমার |

-অমলদা, একটা বড় চা আর একটা ফ্লেক দাও…

-হ্যাঁ বসো, দিচ্ছি…

সামনেই বেঞ্চ পাতা, রাজ বসতে গিয়ে দেখল সামনে মাটিতে একটা মেয়েদের পার্স পরে | চায়ের দোকানে তখন অল্প ভীর, কিন্তু তাতে কোন মহিলা নেই | ইতস্তত করে তুলল পার্সটা |

-চা টা নাও বাবু..

-হ্যাঁ দাও..

চায়ে চুমুক দিয়ে , রাজ পার্সটার দিকে নজর ফেরাল | সাধারণ একটা কালো রঙের পার্স | রঙটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে প্রায় নতুন সেটা | একবার ভাবল খুলে দেখে, ভিতরে নাম টাম আছে কিনা, তারপর কি মনে করে রেখে দিল পাশে |

চা প্রায় শেষের দিকে, সবে উঠতে যাবে হঠাৎ দেখতে পেল একটা মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে দোকানের দিকে এগিয়ে আসছে | এসেই, রাজকে পাশ কাটিয়ে সোজা ঢুকে গেল চায়ের দোকানে,

-দাদা, আমার পার্সটা দেখেছেন ? এখানে কি ফেলে গেলাম?

-কেমন ব্যাগ গো দিদি?

-কালো রঙের ছোট মত… এখানেই কোথাও.

রাজ পার্সটা নিয়ে বলল,

-আচ্ছা দেখুন তো, এটা আপনার কিনা..

-হ্যাঁ এই তো, এটাই তো, ওফ….

-দেখে নিন পয়সা টয়সা..

-এবাবা না না, কি যে বলেন..

– না, দেখে নিন, পরে কিছু কম থাকলে সন্দেহ হবে, তার চেয়ে এখনি দেখে নিন..

-না, মানে… আচ্ছা.. না ঠিক আছে সব.. Thank You, Thanks a lot…

-Its ok..

– আসি..

মেয়েটি চলে গেল, রাজও পয়সা মিটিয়ে বাইরে পা রেখেছে কি, হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল | রাস্তায় লোকজন ছোটাছুটি করে শেড খুঁজতে লাগল , রাজ সামনেই মেস নিয়ে থাকে, সবে ভাবছে ভিজেই চলে যাবে, ওই মেয়েটি ছুটে ঢুকে এল ভেতরে |

রাজের চোখ পড়ল তার ওপর, মনে হল যেন দুনিয়াটা ওখানেই থেমে গেছে, এরম অপরূপ দৃশ্য সে জীবনে কখনো দেখেনি | মেয়েটি হাল্কা ভিজেছ গেছে, তাই এসেই লম্বা চুল খুলে দিয়েছে, রুমাল না পেয়ে ওড়না দিয়েই হাত মুছছে, ঘন কালো চুলগুলো বারবার মেয়েটির মুখের ওপর এসে পরছে, আর বারবার সে ব্যস্ত হাতে সরিয়ে কানের পিছনে রাখছে | রাজ চোখ ফেরাতে পারছিল না, হা করে তাকিয়েছিল ওই দিকে | কে জানে কতক্ষণ ওইভাবে তাকিয়েছিল সে, যেন এক ঘোরে চলে গেছিল | ঘোর কাটল, সামনেই কোথাও বাজ পরাতে | কাছেই মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল, বাজের শব্দে হঠাৎ রাজের হাতটা চেপে ধরল | পরক্ষনেই বুঝতে পেরে হাতটা সরিয়ে নীল, তবে রাজের শরীর দিয়ে ততক্ষণে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল ওই ছোঁয়াতে |

– সরি সরি, কিছু মনে করো না…

– হ্যাঁ?.. ওহ.. না না, ঠিক আছে, মনে করার কি আছে ?

– না, মানে আমার বাজের শব্দে খুব ভয় লাগে..

– ওহ, আচ্ছা… হ্যাঁ অনেকের থাকে বটে…

– হুম… আচ্ছা, এতক্ষণ ধরে কথা বলছি, নামটাই কিন্তু জানা হয়নি… আমার নাম স্বর্ণা.. তোমার ?

এই দেখ তুমি বলে ফেললাম, আসলে কি আমার ওই আপনি ব্যাপারটা বেশিক্ষণ পোষায় না..

– না না, ইটিস ওকে, আমি রাজ…

– ওহ.. তা তুমি কি করো ? মানে পড়াশোনা না চাকরি ?

– আমি Electrical ইঞ্জিনিয়ারিং 3rd Year.. আর তুমি?

– আমি?  আপাতত বেকার বলতে পারো.. হে হে…

– মানে ?

– মানে সবে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে মাস্টার্সের পরীক্ষা দিচ্ছি..

– ওহ.. আচ্ছা..

– আচ্ছা রাজ আমি চলি, বৃষ্টি ধরেছে মনে হচ্ছে..

স্বর্ণা চলে যেতেই, রাজ হঠাৎ কি মনে করে অমলদাকে বলল,

– এই একটা ছাতা হবে ? আমি দিয়ে যাচ্ছি এখুনি…

– হ্যাঁ, ওই তো, নিয়ে যাও…

– আচ্ছা নিলাম, আমি বিকেলে দিয়ে যাচ্ছি..

– আচ্ছা..

রাজ ছাতা নিয়ে হন হন করে বেরোল দোকান থেকে, মেসের উলটো দিকে কিছুটা গিয়ে দেখে, স্বর্ণা কিন্তু বেশিদূর যায়নি তখনো | হনহনিয়ে হেটে পৌঁছল ওর কাছে,

– বলছি কি বৃষ্টিতে ভিজবেন না.. এই নিন ছাতা..

স্বর্ণা হঠাৎ এরম শুনে চমকে উঠেছিল বটে তবে রাজকে চিনতে পেরে এক গাল হাসল |

– এ কি? তুমি ? এদিকে ?

– হ্যাঁ..মানে.. আমি তো এদিকেই থাকি..

– ও.. তা ছাতা কথা থেকে যোগাড় করলে ?

– ওই অমলদার থেকে… পরে দিয়ে দেব..

– কেন ?

– না.. মানে.. এমনি.. আরে ছাতাটা নাও তো…

– আমি একা নিয়ে কি করব ? তোমাকেও কিন্তু আসতে হবে এর তলায়..

রাজ যেন নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছে না, সত্যি এরমও হয় ?

– আমি?… আমি ঠিক আছি..  তুমি নাও..

– না তাহলে আমিও নেব না কিন্তু..

– এবাবা… আচ্ছা চলো চলো.. অবশ্য আগে ছাতাটা তো খোলো..

স্বর্ণা ছাতা খুলল, রাজকে রীতিমতো জোর করে ছাতার তলায় এনে এগোতে লাগল | সারাটা রাস্তা অনেক কথা হল দুজনের, সবই কিন্তু টুকটাক নর্মাল কথা-বার্তা | তবে রাজ বেশীরভাগ সময়টাই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল স্বর্ণার দিকে, ওর কথা বলা, চোখের ভঙ্গী, হাত নাড়িয়ে বোঝানো, মাঝে মাঝে অবাধ্য চুলগুলোকে কানের পাশে গোজা, রাজ যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছিল | আর ছিল , তার হাসি, ওই হাসি যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ |

বড় রাস্তায় এসে তারা বুঝল বৃষ্টি প্রায় থেমে গেছে | ছাতাটা বন্ধ করে রাজকে দিয়ে স্বর্ণা বলল,

– আচ্ছা, রাজ এবার তাহলে আমি চলি, এখুনি বাস এসে পরবে…

– হ্যাঁ… টাটা.. নাইস টু মিট ইউ…

– সেম হিয়ার…. And Thanks Again…

– For what?

– For the everything, for the few moments, and a sweet memory….

– Oh, but the pleasure was always mine….আচ্ছা ওই যে বাস আসছে, আমি আসলাম…

– হ্যাঁ, বাই.. তবে একটা কথা রাজ.. ওভাবে ভ্যাবলার মতো আর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থেকো না..কোনদিন জুতো খেয়ে যাবে.. হে হে..

– এ হে.. সরি সরি.. তা তুমি লক্ষ্য করেছিলে নাকি…

– উহু.. মেয়েরা সব বুঝতে পারে.. 6th Sense….বুঝলে রাজ বাবু..

“যাদবপুর থানা, South City, টালিগঞ্জ.. খালি বাস, খালি বাস..”

– আসি..

– হ্যাঁ বাই, স্বর্ণা…

বাসটা হুস করে বেড়িয়ে গেল সামনে দিয়ে, যতক্ষণ বাসের চলে যাওয়া দেখতে পাওয়া যায়, ততক্ষণ সে দাড়িয়ে রইল, তারপর আসতে আসতে ফিরতে শুরু করল |

পথে অর্কর সাথে দেখা হল তার, অর্ক তার ছোটবেলার বন্ধু, এপাড়াতেই থাকে..

– কি বে ? স্বর্ণাকে ছেড়ে এলি নাকি ?

– তুই জানলি কি করে ?

– আরে চাদু, এসব খবর যে হাওয়ায় ওরে.. অমলদা বলল তুই নাকি ছাতা নিয়ে কোন মেয়ের পিছন পিছন গেছিস.. হে হে

– ওফ অমলদাটা না..

– আরে বাবুর রাগ হল নাকি ? আরে, আমার বাড়ির সামনে দিয়েই তো স্বর্ণা কে দেখলাম যাচ্ছে ছাতা মাথায়, পাশে একটা ছেলে, তারপর যখন অমলদা বলল, দুই দুইয়ে চার…

– ওহ..

– তা বাবুর কি নম্বর লাগবে নাকি ? আমার জুনিয়ার ছিল কিন্তু স্কুলে, যোগাড় করে দিতে পারি বললে..

– না… থাক…

– কেন বে ?

– না রে জানিস তো, কিছু কিছু সম্পর্ক, অল্প কিছু মুহূর্তের মধ্যেই বেচে থাকুক…. সব কিছুকে এক ধাঁচে ফেললেই যে মুশকিল শুরু |

– মানে ?

– মানে অনেক কিছু.. বুঝবি না.. চল এলাম রে.. কাল শিবতলার মাঠে আসিস ভোর ৬টায়..

– তুই এক নম্বরের দার্শনিক হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন.. আচ্ছা কাল দেখা হবে..

রাজ ছাতাটা অমলদাকে দিয়ে মেস ফেরত চলে গেল |

সত্যি, কিছু মুহূর্ত, কিছু ভালোলাগার অনুভূতি আর ক্ষণিকের পরিচয় নিয়েই বেচে থাকুক না কিছু সম্পর্ক, নিভৃতে, একান্তে……

Facebook Comments Box
Staff Writer

Editorial Team of LaughaLaughi

Recent Posts

Kolkata to Witness B Praak’s Mesmerizing Performance at ‘Kolkata Odyssey’ on October 20th

The vibrant city of Kolkata is set to host an extraordinary musical event as renowned Indian music…

3 months ago

Celebrating Friendship and Togetherness with Pujo Pujo Gondho

In a heartwarming ode to friendship and the unifying spirit of Pujo, SVF Brands has…

3 months ago

Frustration Turned To Calmness, Thanks To These Websites

The year 2024 has not been what I had planned so far. Everything went downhill.…

4 months ago

SVF Music Unveils April Edition of “Banglar Gaan Indies”

Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…

9 months ago

Mimi Chakraborty and Nabila to Star Alongside Shakib Khan in ‘Toofan’

Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…

10 months ago

Why Does a Rich Chicago Law Firm Keep Suing Indian Tribes?

This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…

1 year ago