তারা খসে পরে

তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বহু না মেলাতে পারা অঙ্কের কথা ভাবে নীলাভ। তবে ও এতকিছুর পরও বিশ্বাস করে এইখান থেকেই শুরু করা যায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমন্ডল খুঁজতে থাকে ও… আচমকা ওর ফোনটা বেজে ওঠে… স্ক্রিনে চোখ রেখে দেখে সেই নাম! 

নীল সামিয়ানার নিচে বসে এমন তারা গুনতে গুনতে ও বেশ কয়েকবার কথা বলেছে আগে, তবে তখন ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল! তখন ওদের মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিল… যেটা আজ আর নেই। এমনদিনে একটু বিয়ার পেলে মন্দ হতোনা… ফোনটা বেজেই চলেছে তাই রিসিভ করে এবার, “হ্যালো!”

“কেমন আছো?” ওপাশ থেকে সেই কণ্ঠস্বর। 

“ভালো আছি, তুই?”

“আমিও ভালো আছি।” তারপর একটু নীরবতা, এরপর বললো, “নীল! এই করোনা, লকডাউন আর পরপর যা ঘটে চলেছে এর মধ্যে আমার তোমার কথাই মনে পরলো… অনেকদিন তোমার সঙ্গে কথা হয়নি…” 

“হুমম, সাবধানে থাক… বল তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?” 

“ভালো নয়… এই অবস্থায় পড়তেও ভালো লাগছেনা।” রিম্পার গলার স্বরে যেন বিষন্নতা টের পায় নীলাভ। ও বলে, “কিছু করার নেই, যা ভালো লাগে কর, মাঝে মাঝে পড়… আর কিছু বলবি?” 

“নাহ তেমন নয়, তুমি ব্যস্ত?” 

“ওই একটু, বেশ তাহলে রাখ…” 

“ওকে, বাই!” নীলাভ জানে ও প্রকাশ না করলেও ভিতরে ভিতরে ওর মন অস্থির হয়ে উঠেছে। বড্ড নিঃসঙ্গ লাগবে এরপর কয়েকটা দিন… আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর দিকে তাকিয়ে  মিটমিট করে জ্বলছে যেন অতগুলো তারা… কেন এতদিন পর এভাবে ফোন করলো রিম্পা? যদিও কথা বাড়ানোর সুযোগ ও দেয়নি তাও ও জানে অসুবিধা হবেই… এরপর নানা পুরোনো স্মৃতি এসে কড়া নাড়বে ওর মনের ঘরের দরজায়… 

(সংগৃহীত)

কয়েকদিন পর… 

রিম্পা কলেজের কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করে বুঝলো এখন সবাই দিব্যি ল্যাদ খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। তবে আর এভাবে সারাক্ষন বাড়িতে ভালো লাগছেনা ওর। নীলাভ ওর প্রাক্তন প্রেমিক, ওকে পড়াতো আর সেখান থেকেই ওদের সম্পর্কের শুরু… তারপর কয়েকমাস সব ঠিকঠাক চলার পর ওরই আর ভালো লাগছিলোনা… কেমন যেন নিজেকে পরাধীন মনে হতো, যদিও নীলাভ ওকে চালনা করতো তা নয় তবু ওর অনিচ্ছা হচ্ছিলো, বরং বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগতো প্রেমিকের থেকে… হয়তো এজ ডিফারেন্স ছিল আর টিচার ছিল বলেই কি এমন হতো? ও জানেনা, তবে ও সম্পর্কটা ভেঙে দেয়… পিছন ফিরে দেখতেও খুব একটা ইচ্ছে হয়নি… বরং ওর সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার পর জীবনটা অনেক বাঁধনছাড়া মনে হয়েছিল। আসলে তেমন রঙিন ছিলনা ওদের প্রেম… ছাদে বসে তারা দেখতে ভালোবাসতো নীল আর ওর এসব ভালো লাগতোনা! নর্থপোল আর সাউথপোল ছিল… আর সেইসময় এক ক্লাসমেট ওকে প্রপোজ করে যদিও ও তখন আর নতুন সম্পর্কে জড়ায়নি। তবে নীলাভর থেকে সে অনেক হ্যান্ডসাম ছিল। সেদিন ওর একা লাগছিলো বলে নীলাভকে ফোন করেছিলো… আর বহুদিন পর নীল বলে ডেকে ওর নিজেরই অস্বস্তি হচ্ছিলো। আসলে বিচ্ছেদের বছর চারেক পরেও ওর মা চায় ওদের আবার সব মিটমাট হয়ে যাক। ও এরমধ্যে আরেকটা সম্পর্কে জড়িয়েছিল কিন্তু সেটা এখন আর নেই।

আজ আবার ছাদে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে নীলাভ দেখলো তারা নেই, বরং মেঘ করেছে… গতবছর চাকরিটা পাবার পর অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছে ও। একটাসময় সরকারি চাকরির আশা প্রায় ছাড়তে বসেছিল ও। তবু শেষ চেষ্টা করছিলো আর তখনই চাকরিটা পেলো। বাড়িতে সবাই খুব খুশি হয়েছিল। এই লকডাউনে বহু বন্ধুদের সাথে ওর ফোনে কথাবার্তা হল অনেকদিন পরে। তবে রিম্পা ফোন করবে ও আশা করেনি। তবে যেসব বন্ধুরা বেকার অবস্থায় ওর সঙ্গী ছিল তারা অনেকেই চাকরি পাবার পর যেন দূরে সরে গেছে… ও নিজেও আগেরমত যোগাযোগ রাখতে পারেনি আসলে, দোষ ওরও আছে। আর অফিসকলিগরা বোধহয় কখনো তেমন বন্ধু হয়না। ব্যর্থ সময়ে মানুষ পাশ থেকে যেমন সরে যায় তেমনি সাফল্য মানুষকে একা করে দেয় সেটা সফলতা না পেলে ও জানতে পারতোনা। ব্যর্থতার সময়েও কিছু মানুষ ছিল ওর কাছে… ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো… নীলাভ ভিজতে থাকলো। তারা না থাক আজ বৃষ্টিকণারা  ওর সঙ্গী হোক… 

(সংগৃহীত)

“কি রে, যতদিন চাকরি পাসনি আমি তোকে বিয়ের জন্য কিচ্ছু বলিনি… একবছর হল এবার তো ভাব… ” নীলাভকে ওর মা বললো। 

“দেখো তোমরা… “

“তোর মধ্যে সেরকম আগ্রহ দেখছিনা, কেন রে?” 

চুপ করে থাকে নীলাভ। আর তখনই একটা উচ্ছল মেয়ের কথা মনে পড়ে ওর, যার দুটি চোখ যেন উজ্জ্বল দুটো তারা… যাকে ও একদিন বলেছিলো, “তুই পুরো… ” 

“কি আমি?” 

“জানিনা, কিছু নয়… ” 

“তুমি সেন্টেন্সটা কমপ্লিট করবে?” 

“তুই পুরো বুঝে যাস সবকিছু… হ্যাপি এন্ডিং তুইও চাস! সবাই চায় বল!” 

“তুমিও চেয়েছিলে বলো…” 

“চাইলেই কি সব হয়?” নীলাভ বলেছিলো। ওর আর রিম্পার সম্পর্কের বিচ্ছেদের কথা সেও জানতো। সেই মেয়েটা ওর প্রেমিকা ছিলোনা, বান্ধবী ছিল। 

“হুমম সব উপন্যাসের হ্যাপি এন্ডিং হয়না… ” সে বলেছিলো। 

“আমার প্রেমটা উপন্যাস হতেও পারেনি, চেয়েছিলাম লিখতে… কিন্তু ওটা ওই একটা অনুগল্প হয়েই রয়ে গেল।” নীলাভর উত্তরটা শুনে কয়েক মুহূর্ত নীরব ছিল সে তারপর বলেছিলো, “রূপকথা তৈরি করা সহজ নয়, তারজন্য অনেক লড়াই করতে হয়। একজন ঠিক মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে অনেক ভুল মানুষকে পেরিয়ে আসতে হয়… রূপকথা গড়ে তোলা সহজ নয়!” ওর কথা শুনলে মনে হতো যেন রাতজাগা তারা! মায়ের মতোই ভালো!

“কি ভাবছিস বলবি?” মায়ের ডাকে ওর সম্বিৎ ফেরে। 

জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নীলাভ। “মা, একটা মেয়ে ছিল, আমার বন্ধু। ওর সাথে দুবছর কোনো যোগাযোগ নেই… ওর কথা তোমাকে বলিনি কখনো… মেয়েটা আমাকে মিস করতো, অভিমানী হতো আকাশের তারা যেমন করে দেখা না পেলে ঠিক তেমন… আমি টের পেতাম আর সেভাবে ওকে পাত্তা দিতামনা, নিরুপায় ছিলাম তাই উপেক্ষা করেছি… জানিনা বিয়ে হয়ে গেছে কিনা! একবার বলেছিলো তোমার বিয়ে নাহলে আমিও বিয়ে করবোনা…” 

“ফোন নাম্বার নেই?” 

“আছে, সেটা বদলে ফেলেছে কিনা জানিনা…” 

“ফোন করে দেখ, আর দেরী করিসনা, না পেলে অন্য বন্ধুদের কাছে খোঁজ কর… ঠিক পেয়ে যাবি তাকে, সে অপেক্ষা করছে।” নীলাভ ওর মায়ের কথা শেষ হতেই দেখে একটা তারা খসে পরে… 

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *