সেদিন হঠাৎ আমি ঘুমের দেশে,
ড্রয়িংরুমে পড়ে থাকা ক্যানভাসটায় তুলির আঁচড় কাটছিলাম।
গ্রামের যে আঁকাবাঁকা রাস্তার দুপাশে সবুজের সমারোহ;
সেই পথের পথিক ছিলাম আমি এবং আমার একমাত্ৰ সঙ্গী― একাকীত্ব!
তুলির দাপটে নীলচে রঙ যখন ক্যানভাস স্ট্যান্ডের বাইরের জগতকে আঁছড়ে পড়লো,
ঠিক তখন স্মৃতির চ্যাপ্টার বাঁক নিলো পিছন পানে।
সে অনেক গল্প…
বছর ৩-এর ছেলে, যাকে পুকুরের গভীরতায় হারিয়ে গিয়েও ফিরে আসতে হয়,
সেই ছেলের বয়স যখন সবে ৮,
তখন ডাক্তার বললেন, “He is not a normal child, he has a major heart disease. It’s called Trancus Arteriosus.
বিশ্বে এক লক্ষের মধ্যে একজনের হয়…”
তবুও দমেনি সে।
সাফল্যের সাথে স্কুলের গন্ডি অতিক্রম করে এই ইনট্রোভার্ট ছেলেটা কলেজের ব্যস্ততা ভরা জীবনে প্রবেশ করলো,
বসন্তের ছোঁয়া প্রথমবার তার মোহময়ী মনে হয়ছিলো,
পাগল করে তুলেছিল তাকে।
কিন্তু, আবারও সেই ডাক পড়লো ডাক্তারের;
জীবনের সাথে কুস্তির লড়াইয়ে নামতে হলো আরেকবার।
তবে, এবারে পাওয়া প্রতিটি অসহ্য পীড়ন ছেলেটিকে ‘মানুষ’ চিনিয়ে ছিল।
বন্ধুবিচ্ছেদ, প্রেমের সম্পর্কে ভাঙন―
এই সবকিছুর শেষে মানসিক ও শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত ছেলেটি যখন একটু মানসিক সমর্থন খুঁজছিল,
তখন তার মাথায় বাবা-মা ছাড়া আর কেউ হাত রাখেনি।
সবার চোখে নিজের জন্য শুধু করুণা ও সহানুভূতি দেখেছিল,
যা ভেতর ভেতর দুর্বল করে তুলেছিল তাকে।
তারপর থেকে সে ভুলে গেছে ভালোবাসতে,
ভয় পেয়েছে কাউকে আঁকড়ে ধরতে;
কারণ, কাছের মানুষকে হারিয়ে ফেলার বদঅভ্যাস, অথবা কাউকে নিজের কাছে কাছে রাখার অপারগতা গ্রাস করেছিল তাকে!
নিজেকে পুনরায় আঘাত পাওয়ার থেকে বাঁচানোর জন্য জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে দুঃখ ও একাকিত্বের বেড়াজালে মুড়ে ফেলেছিল সে নিজেকে।
একদিন সমস্ত বেড়াজাল ভেঙে আবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটার উপক্রম হলো।
হঠাৎ করেই কেউ একজন এলো, যে তার চিন্তা-ভাবনার সীমানায় থাকা প্রাচীর ভেঙে দিলো।
কারণ, ছেলেটি এর আগে এমন জেদী, একরোখা ও মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষের এত কাছে আসেনি।
তার জীবনের বিশেষ জায়গাটি পাওয়ার জন্য কেউ এতটা লড়াই করেনি,
ভালোবাসেনি তাকে এতটা আবেগ-প্রেম-অনুভূতি-যত্ন সহকারে।
যদিও হারিয়ে ফেলার ভয় ছেলেটি আজও পায়, কিছুটা অভ্যাসের দরুণই।
“খোকা! খোকা! অনেক বেলা হলো। এবার ঘুম থেকে ওঠ।”
মা’এর ডাকে ঘুমটা ভাঙতেই নাকে একটা নেশামাখা গন্ধ ভেসে এলো,যা তার অতি চেনা।
জানলার বাইরে উঁকি মারতেই সে দেখতে পেলো যে, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে;
ভিজে মাটির সেই গন্ধ….
এমন সময় ফোনের ডায়ালপ্যাড ঘোরাতেই অপরপ্রান্তের কলার টিউন বেজে উঠলো,
“হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল, মিঠে কুয়াশায় ভেজা আস্তিন
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম আর তুই কাকে ভালোবাসতি…”
৫ সেকেন্ড পরে ওপার থেকে ভেসে এলো, “The number you have dialed is busy…”
কিছু নীলচে ক্যানভাসে হয়তো স্মৃতিরা এভাবেই হানা দেয়, হোক না তা ঘুমের দেশে।
আর কিছু সকালে ক্যানভাসের রঙ সাদা-কালোতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়!