Categories: I got a story to tell

বড়দিনের একাল সেকাল; এক বড়দিনের গল্প

আমাদের বড়দিনে নাহুমসের কেক ছিল অনেক দূরের গপ্প। শীত পড়ার প্রায় সাথে সাথেই কেক খাওয়া শুরু হয়ে গেলেও বড়দিনের সকালে বাবার আনা লোকাল বেকারির কাপ কেক বা বাটি কেক খাওয়ার আনন্দটাই ছিল অন্যরকম।আমার বড়দিনের সকাল ভিক্টোরিয়ার চূড়া ছুঁয়ে আসতো কি না জানিনা, তবে আমার কিছু প্রিয় মানুষের আঙুল জড়িয়ে ঠিক আসতো।

আমাদের যে অনেক দূরের বেলাটাকে ছোটবেলা বলে সেই বেলায় বড় ছোট ছোট জিনিসও অনেক বড় বড় অ্যাডভেঞ্চার জড়িয়ে আসতো। আমাদের কোয়ার্টারের রুমে ঢালাইপাটা থাকতো। বড় মানুষেরা যাকে “সানসেট” বলে। আমার সেই সোনালী রোদের, ঝরা পাতার রঙ মাখা শীতের সকালে “বড়দিনে” ঘুম ভাঙতো একবুক রহস্য নিয়ে। বাবা এবার কেক এনেছে তো? কি কেক এনেছে?বায়না করে চিৎকার শুরু করার আগেই বাবা হাজির। বাবা বলবে না, আর আমিও ছাড়বো না। তারপর বাবার কাঁধে চেপে দুহাত বাড়িয়ে সেই উঁচু ঢালাইপাটা থেকে নামিয়ে আনতাম বছরের শেষ রহস্য। কাগজের কাপে মোড়া আদরের কাপকেক। অনেক বছর পেরিয়ে গেছে মাঝে। পেস্ট্রি, ফ্রুটকেক ছাড়িয়ে আজ নাহুমসের সাথেও বেশ ভালো বন্ধুত্ব।শুধু আজ আর শুকনো পাতার গন্ধ মেখে বাবার কাঁধে চেপে তেমন রহস্য মাখা বড়দিন আর আসেনা। 

বড়দিন মানে যীশুর বাড়ি যাওয়া। আমি প্রথম যীশুর বাড়ি “চার্চ” গেছলাম পৌষে নয়, এক চৈত্র সন্ধ্যায়। আমার এক প্রিয় বন্ধুর হাত ধরে।আমার সব আবদার রাখা সান্তা ছিল সে। আকাশে পড়ে আসা আলো মেখে যীশুর সামনে মোমবাতির আলো জ্বেলেছিলাম। সেই আলোর সামনে দাঁড়িয়ে সে বলেছিল, জানিস যীশুর ঘর থেকে কেউ কখনো খালি হাতে ফেরে না। মন দিয়ে চাইবি যেটা সেটা যীশু ঠিক তোকে ফিরিয়ে দেবে, আজ না হয় কাল। কিন্তু দেবে ঠিক ই। তাই সবার ভালো চাইবি। দেখবি সবার মাঝে তোকেও রেখে যীশু তোকেও সবকিছু দেবে। দেখে নিস।  না আলাদা করে দেখা হয়নি। বহু বছর যোগাযোগ নেই তার সাথে। আলাদা করে চৈত্র কিম্বা শ্রাবণ কখনোই আর যীশুর সাথে দেখা করতে যাওয়া হয় না এই একটা দিন ছাড়া। তবুও যতবর চার্চ যাই, মনে হয় সেই প্রথম বারের মতো সেই প্রিয় মানুষটার হাত ধরে যীশুর সামনে গিয়ে দাড়াচ্ছি। আর সবার ভালো চাইতে চাইতে ভাবি, এই সবার মাঝে তাকেও ঠিক রেখে দেবে নিশ্চয়ই যীশু। বড়দিন বলে কথা, তিনি কি কথা না রেখে থাকতে পারবেন? আমার জীবনের সান্তা ছিল যে সেই মানুষটা। তার জন্য বড়দিনে এটুকু চাইতেই পারি, তাই নয় কি? 

আজকাল দেখি কতো খ্রিসমাস ইভ, কত পার্টি হয়। সময়ের সাথে তাল মেলাতে, কাজের জন্য, ইচ্ছে না থাকলেও এমন অনেক যায়গায় যেতে হয়। কতো নামিদামি কেক, নামি দামি পোশাক। কত নাম না জানা খাবার, ড্রিংক। শুধু রঙবেরঙের আলোর রোশনাইয়ের মাঝে আমার সেই ছোটবেলার মোমবাতি জ্বালা বড়দিন খুঁজে পাই না। এতো মানুষ চার্চ গিয়ে ছবি তোলে, দুটো হাত জড়ো করে সেই তার মতো সবার ভালো চাইতে আর কাউকে দেখি না। লক্ষ লক্ষ ছবির মাঝে নরম ভালোবাসা আর ভালো থাকার ছবিগুলো আজকাল বড্ড হারিয়ে যাচ্ছে। কিম্বা আমার বয়স হচ্ছে নাকি, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। 

আজকাল যখন আমার থেকে অনেক খুদে মানুষ গুলোকে দেখি বাইরের রঙ , আলোটুকু নিয়ে হৈচৈ করতে তখন কোথাও গিয়ে ভালোলাগা আর খারাপলাগা একসাথে জড়িয়ে ধরে। এদের মতো আমাদের মা, বাবা কিম্বা ভালোবাসার কোন মানুষ বাড়িতে সাজানো খ্রিসমাস ট্রির নিচে পছন্দের কোন জিনিস আমাদের জন্য রেখে যেতো না। বরং না জেনেও সারা বছর ধরে কতো পছন্দের জিনিস একটু একটু করে দিয়ে যেতো আমাদের অজান্তে, সারা বছরের শান্তা হয়ে, আমরা বুঝতেও পারতাম না। এরা এতো জানে যে সারা রাত ধরে ভোরে শান্তা কি গিফ্ট ঝোলানো মোজায় ভরে রেখে যাবে ভেবে আধঘুমে রাত কাটায় না। বরং পছন্দের কিছু পাবে জেনে নিশ্চিন্তে সারারাত ধরে পার্টি কিম্বা তার প্ল্যান করে। এরা যেমন শান্তা র রহস্য বুঝবে না, বাবার কোলে চেপে বাটি কেক কিম্বা মেলা বুঝবে না, ঠিক তেমনি আমরা ওদের সোজা সাপ্টা জীবন বুঝবো না। ওরা কোন শান্তা র গল্প সারা জীবন বুকে আগলে বাঁচে না, বরং তাকে নিয়ে ঘর বাঁধতে চায়, ঘর বাঁধে। যেটা চায় মুখ ফুটে বলতে পারে। ওরা যীশুর কাছে দাড়িয়ে হাজার জনের ভিড়ে একজনের জন্য ভালো থাকা চায় না, বরং ওরা তাকেই চেয়ে নেয়, একসাথে ভালো থাকার জন্য। আমরা স্মৃতি জমাই, ওরা গল্প বোনে। আমাদের ছোটবেলা গুলো সহজ সরল ছিল, ওরা সারাটা জীবন সহজ করে রাখতে চায়। 

এতো কিছুর পরেও আমি দুটো যুগের মানুষকেই বড় ভালোবাসি। একটা যুগ আগলে রাখতে শেখায়, একটা ভালোবাসতে। ঐ কচিকাঁচা গুলোর মাঝে সেই গল্পগুলো প্রতিদিন ছুয়ে যাই যে গল্প গুলো বেঁচেছিলাম,কিম্বা বাঁচতে চেয়েছিলাম। আমি আজও বড়দিনের আগের রাতে মোজা ঝুলিয়ে ঘুমোতে যাই। ঐ একটা দিন শান্তা কে অবিশ্বাস করতে পারি না। একজন যে বলেছিল, যীশুর ওপর বিশ্বাস রাখতে। শান্তা যে তার ই দূত। অবিশ্বাস কি করে করি? ঘুমোতে যাই স্বপ্ন দেখি। বাবার কোলে চেপে আমি। কেক খাচ্ছি, মেলায় যাচ্ছি। মায়ের বকুনি। বোনদের সাথে খেলা। মাসির সাথে খুনসুটি। দাদু, দিদুনের আদর। বন্ধুদের সাথে আড্ডা। আর আমার সান্তার কাছে এত্ত আবদার। দেখি ছোটছোট পায়ে হাটা আমির পাশে একটা সাইকেলের আমি, একটা স্কুটির আমি পাশাপাশি চলছে। দেখি স্কুল ফেরা আমি, টিউশনের আমি, বন্ধুদের সাথে আড্ডার আমি, দিদিমনি আমি কেমন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। টুকি দিয়ে যাচ্ছে জীবনের আনাচে কানাচে। বাবা কাপকেক এনেছে। সেই মানুষটা বলছে, মন থেকে চেয়ে দেখ। একদিন সব ফেরে। একদিন সব কিছুকেই ফিরতে হয়। একদিন চাওয়ার সবটুকু ফিরে পাবি।আমার আঙুল জড়িয়ে ধরে অনেকগুলো ছোঁয়া। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। প্রতিবার ছোট, বড় অনেক গুলো মানুষের মুঠোভরা ভালোবাসা পাই। যেগুলো চাই সেগুলো সব হয়তো পাওয়া হয় না। তবুও আমি মন খারাপ করি না। প্রতিবছর চাই। জানি একদিন না একদিন সব পাবো। যীশু কাউকে খালি হাতে ফেরায় না যে ।আর বিশ্বাস না থাকলে কিছু পাওয়া যায় না। তাই আমি বিশ্বাস কখনো হারাই না। 

আমি জানি আমার জীবনে নাহুমস থাকলেও বাটিকেক আনা বাবা ঠিক থাকবে। আমার শান্তা হয়তো অনেক দূর দেশে থাকে। কিন্তু সেখানে ঠিক কাউকে অনেক ভালো রেখেছে। আর সেই ভালোরাখাটা জুড়ে কোথাও আমিও থাকি।আমি জানি আমি বছর শেষে হলেও সেই ঘরে ফিরবো যেখানে আমার ছোটবেলা জুড়ে থাকা মানুষ গুলো রয়ে গেছে। আর যারা নেই, কোনদিন আবার তাদের সাথে দেখা হবে। কারণ তাদের জীবনের কোন না কোন গল্পে একদিনের জন্য হলেও তো আমি ছিলাম। আর  যা কিছুই ফেরত নেওয়া যাক না কেন, কাউকে দিয়ে যাওয়া সময় চাইলেও কখনো ফেরত নেওয়া যায় না। 

কাপকেক হাতে নিয়ে ছোট আমি আর পেস্ট্রি হাতে নিয়ে বড় আমি পাশাপাশি বসবো সময় করে। দেখবো সময়ের অলিগলি বেয়ে কত স্কুল বেলা, মেয়েবেলা, ছেলেবেলা,বড়বেলা যীশুর ঘরে যাচ্ছে। মোমবাতি জ্বালাচ্ছে। ভালো থাকা চাইছে। হাত ধরে ওম জমাচ্ছে আদরের। আর ব্রোঞ্জ রঙের আলো জড়িয়ে শীতের বিকেল আলতো করে ছুয়ে যাবে আমায়। বারবার, প্রতিবার। অন্তত ততবার যতবার দেখার জন্য দুচোখ মেলতে পারবো আমি। ফিরে পাওয়ার অপেক্ষা করতে পারবো আমি। কারণ সান্তা যে বলে গেছে, বিশ্বাস থাকলে সব মেলে। আর শান্তাকে অবিশ্বাস করার ক্ষমতা বড়দিনে আমার অন্তত নেই। 

কখনো সুযোগ হলে কান পেতে শুনে দেখো। বড়দিনের বিকেলে বাতাসে শব্দ মাখিয়ে শুধু মানুষ নয় যীশুও বার্তা পাঠায়, মেরি খ্রিসমাস। ভালো থেকো সবাই। সবার মাঝে আমি তোমাদের ভালোবাসার মানুষ গুলোকে ঠিক ভালো রাখবো।সবদিন।শুভ বড়দিন। 

Facebook Comments Box
Subhra Roy

Recent Posts

Kolkata to Witness B Praak’s Mesmerizing Performance at ‘Kolkata Odyssey’ on October 20th

The vibrant city of Kolkata is set to host an extraordinary musical event as renowned Indian music…

3 months ago

Celebrating Friendship and Togetherness with Pujo Pujo Gondho

In a heartwarming ode to friendship and the unifying spirit of Pujo, SVF Brands has…

3 months ago

Frustration Turned To Calmness, Thanks To These Websites

The year 2024 has not been what I had planned so far. Everything went downhill.…

4 months ago

SVF Music Unveils April Edition of “Banglar Gaan Indies”

Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…

8 months ago

Mimi Chakraborty and Nabila to Star Alongside Shakib Khan in ‘Toofan’

Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…

9 months ago

Why Does a Rich Chicago Law Firm Keep Suing Indian Tribes?

This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…

1 year ago