আমি চন্দ্রবিন্দুর ‘সুইটহার্ট’ গানটা শুনে-বুঝে, বেশ প্রস্তুতি নিয়েই কলেজে গিয়েছিলাম প্রথমদিন। মফঃস্বলের ছেলে, তাই কলকাতার কলেজ নিয়ে বেশ একটা কৌতূহল ছিল মনে। কিন্তু যা ভেবেছিলাম তার কিছুই হলনা তেমন। সবই খুব সাধারণ। যে যার মত আড্ডা মারছে, প্রেম করছে, কেউ ক্লাস করছে কেউ করছে না। যাই হোক, সিঁড়ি দিয়ে উঠে তিনতলায় ডিপার্টমেন্টে গেলাম। সিঁড়ির বাঁদিকের কোণটায় সেই প্রথমবার দেখলাম মধুছন্দাদিকে। নীল ডেনিম, সাদা স্লিভলেস টপ, আরেকটা কালো হেয়ার-ব্যান্ড। না সেই প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়েছিলাম কিনা তা এখন আর মনে নেই। তবে ঐ নীল ডেনিমটার প্রেমে অবশ্যই পরেছিলাম। সেদিন মধুছন্দাদি আমার দিকে তাকিয়েছিল একবার। হ্যাঁ এটা স্পষ্ট মনে আছে আমার, ঐ চাহনি আমি এ জীবনে ভুলব বলে মনে হয় না। না সেদিন আর কোন কথা হয়নি ওর সাথে। নিজে থেকে গিয়ে আলাপ করতে আমি পারিনা কোনোদিনই, অগত্যা…
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। কলেজে এখন বেশ ধাতস্থ হয়েছি, নতুন ফ্রেন্ড সার্কেল হয়েছে, ফ্রেশারসে গিটার বাজিয়ে গান গাইলাম আর চুটিয়ে কবিতা লিখছি তখন। মধুছন্দাদিকে কিন্তু আমি রোজই দেখতাম চুপিচুপি, কথা হতনা বেশি। ও আমাকে দেখত কিনা জানিনা, না ই হবে। আমি জমিয়ে আলাপ করতে চাইছিলাম, মন চাইছিল ওকে চিনতে, জানতে; কিন্তু সুযোগ হচ্ছিল না। মাসখানেক পর সুযোগ এলো। যাদবপুরে একটা কবিতাপাঠ প্রতিযোগিতার জন্য ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট ইয়ার থেকে আমি আর সেকেন্ড ইয়ার থেকে পাঠানো হল মধুছন্দাদিকে। আমি এতদিন জানতাম না যে ও কবিতা লেখে। কিন্তু সেদিন মধুছন্দাদির কবিতা শুনে আমি অফিসিয়ালি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম। দুটো লাইন মনে আছে আজও,
″ফিনিক্সও আজ উড়ে গেছে ধ্বংসের ধুম্রতায়,
ইচ্ছেগুলো ছাই হয়েছে দহনের পূর্ণতায়…″
প্রেমে পড়লাম কিন্তু চোখেমুখে প্রকাশ করলাম না কোনোভাবেই। আমিও একটা কবিতা আবৃতি করলাম। মঞ্চ থেকে নেমে আসতেই মধুছন্দাদি বলল,
‘প্রেমে পড়ে গেলাম রে তোর কবিতার।’
‘কি যে বল, তোমারটার তুলনা নেই’, আমি বললাম। এভাবেই কথা শুরু হল আমাদের। একসঙ্গে কাটালাম গোটা দিনটা, গল্প করলাম, ফুচকা খেলাম, ঝরা পাতায় হাটতে হাটতে অস্তমিত সূর্য দেখলাম। তারপর দিনের যাওয়ার সাথে সাথে আমরা কবে যেন কাছের বন্ধু হয়ে গেলাম। মাস ছয়েক কেটে গেল। আমি কিন্তু মনে মনে ভালবাসতাম ওকে, কিন্তু বলার সাহস করে উঠতে পারিনি। ওর পুরনো প্রেমিকের কথা বলত আমায় মাঝে মাঝে, আমি শুনে যেতাম কিছু বলতাম না কোনোদিন। আসলে ভাল লাগত না ওর পুরনো প্রেমের গল্প শুনতে। আমিতো আমাদের প্রেমের উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলাম। মাঝে মাঝে মনে হত, ও তো আমার থেকে বড়, দিদি আমার, ওকে ভালবাসাটা কি বৈধ! তারপর ভাবতাম, বড় হয়েছে তো কি হয়েছে, ভালবাসাটাই বড়। আসলে ঐ বয়েসে এরকম প্রেম বিপ্লব উদয় হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এত সবকিছুর মাঝে কোনোদিন ওর মতামতটা নেওয়া হয়নি। ওর জন্য একটা কার্ড বানিয়েছিলাম, বাড়তি যত্ন নিয়ে দুটো লাইন লিখেছিলাম,
“আমি রহিব গোপনে তোমার ছায়াতলে,
রাখিব মোর প্রেমের কুসুম বক্ষ বিহনে..”
একটা নীল খামে ভরেছিলাম কার্ডটা। দেওয়া হয়নি, সবসময় ব্যাগে রাখতাম ওটা। সুযোগ পায়নি দেবার।
ঐ বছর ডিপার্টমেন্টের সবাই মিলে বেড়াতে গেলাম শান্তিনিকেতনে।
আমি সবসময় মধুছন্দাদির পাশেপাশেই থাকার চেষ্টা করছিলাম। হলুদ শাড়িতে রাজকন্যার মত লাগছিল ওকে। যতবার দেখছিলাম মুগ্ধতা অবশ করে দিচ্ছিল আমার শরীর মন। একটা লাল টকটকে পলাশ কুড়িয়ে এনে দিয়েছিলাম ওর হাতে, হাসি ফুটেছিল ঘামে সিক্ত ঠোঁটে। সেদিন দুপুরে ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম কোপাই-এর তীরে । নদীতে পা ডুবিয়ে বসেছিলাম দুজনে। অনেক কবিতা শুনিয়েছিলাম সেদিন ওকে। নদীর জলে মুখ ধোয়ার পর, শাড়ির আঁচলে মুখ মুছিয়ে দিয়েছিল ও আমার। এক অদ্ভুত মায়াভরা চোখে তাকিয়েছিল ও।
সেই দৃষ্টিতে প্রেম ছিল বলেই ভেবেছিলাম আমি। ফিরে আসার আগে ঠিক হয়েছিল যে পরদিন পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে আবার আবার আসব কোপাইতে।
ফিরে আসার পর সেইরাতে ঘুমোতে পারিনি আমি। যতবার চোখের পাতা এক করেছি ততবার ভেসে উঠেছে ওর ছবি। সেদিন আমি এটা ধরেই নিয়েছিলাম যে মধুছন্দাদিও আমায় ভালবাসে। আসলে মস্তিষ্ক অন্য সম্ভাবনার কথা ভাবলেও, মন টা সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দিচ্ছিল। সারারাত ভেবে-টেবে ভোররাতের দিকে ঠিক করলাম যে কাল কোপাইয়ের তীরেই মধুছন্দাদিকে প্রেম নিবেদন করব। আবার সেদিন প্রেম বিপ্লবটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
সন্ধ্যে সাতটার দিকে আমরা পৌঁছালাম কোপাইয়ে। পাঞ্জাবির পকেটে ঐ নীল খামটা নিয়েছিলাম। চাঁদটা তখন জ্বলজ্বল করছে আকাশে আর কোপাইয়ের শান্ত স্রোতে রূপোলী রেখা গুলো যেন তারাদের মিছিল। আবার পাশাপাশি বসলাম দুজনে পা ঝুলিয়ে। মধুছন্দাদি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল চাঁদটার দিকে আর আমি মধুছন্দাদির দিকে। একটা ফুরফুরে হাওয়া এসে মাঝে মাঝেই ধাক্কা দিচ্ছিল চোখে মুখে। আর নাকে নিয়ে এসেছিল ওর সোঁদা ত্বকের গন্ধ। মধুছন্দাদি নিজের অজান্তেই আমার অনেক কাছে চলে এসেছিল, খুব কাছে।
আমি ওর থুতনিটা ধরে মুখটা আমার দিকে ঘুরিয়ে বললাম, ‘খুব ভালবাসি তোমায় মধুছন্দাদি। খুব ভালবাসি। হাতটা ধরে থাকতে চাই সারাটা জীবন।’ ঐ কয়েক সেকেন্ড মধুছন্দাদির কি হয়েছিল তা আমি বুঝতে পারিনি তখন, থমকে গিয়েছিল ও। এবার আর ফুরফুরে নয়, একটা দমকা হাওয়া এসে ধাক্কা দিল আমাদের। সেই হাওয়ায় ভেসে আমিও ঠোঁট ছোঁয়ালাম মধুছন্দাদির ঠোঁটে। আচমকা এক ধাক্কায় দূরে ঠেলে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল ও। আমি একবার ডাকার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। একটা তীব্র অপরাধ বোধ ছিঁড়ে খেতে থাকল আমায়। নিজের ওপর ঘেন্না হতে লাগলো খুব। আমার ভেতরের পশুটা এভাবে আমার মনের বিরুদ্ধাচারণ করবে টা ভেবে ভেবেই মাথাটা ব্যথা করছিল। খাম সহ কার্ডটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম কোপাইয়ের জলে। অনেক রাতে সেদিন ফিরেছিলাম আমি। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলাম না কিছুতেই।
পরদিন সকালে আর দেখা হয়নি মধুছন্দাদির সাথে। আর ফিরে আসার পরই ভয়ানক জ্বর হয় আমার। অত রাত পর্যন্ত নদীতে থাকার ই ফল। প্রায় পনেরো দিন পর কিছুটা সুস্থ হলাম। জ্বর মানুষকে অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়। অ্যান্টিবায়োটিকের কড়া ডোজ্ সেই রাতটাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল যতটা সম্ভব। দেখি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ সবেতেই ব্লক করেছে ও। যোগাযোগ করার তেমন চেষ্টাও করিনি। কিছু বলার ভাষা ছিলনা আমার ওর কাছে। কলেজে গেলাম কয়েকদিন পর। ওকে দেখলাম না। ও আর কলেজে আসত না তেমন। আমিও পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। না ওকে ভুলিনি, ক্ষতটাকেও না।
তখনও গীটারের সুর তাড়া করে বেড়াত মধুছন্দাদির স্মৃতি। মধুছন্দাদির জীবনের কবিতার ছন্দ হতে চেয়েছিলাম আমি, কিন্তু ছন্দহীন বেদনা হয়ে রয়ে গেলাম। আসলে তখন আমার মন এটা বুঝতে পারেনি যে, কবিতাকে ভালবাসা আর কবিকে ভালবাসা এক জিনিস নয়। এও বুঝিনি যে, মধুছন্দাদি আমার মধ্যে একজন ভাল বন্ধু খুঁজেছিল। মনের মানুষ খুঁজেছিল ঠিকই তবে বন্ধুও যে মনের মানুষ হতে পারে তা আমার বেঢপ মন বোঝেনি – বুঝতে চায়নি। প্রেমিক হতে গিয়ে বন্ধুও হতে পারিনি আমি।
সেদিন এক বন্ধুর ফেসবুক থেকে দেখলাম মধুছন্দাদি পেলিংএ বেড়াতে গেছে। রেলিং ধরে ছবি দিয়েছে একটা। সেই নীল ডেনিমটা পড়েছে। রঙ চটে গিয়ে একটা সাদা সাদা শেড এসেছে এখন, সঙ্গে সেই মায়াভরা চাহনি। নাহ্ আর দেখতে পারলাম না। আমি আর ঐ নীল ডেনিমের প্রেমে পড়ব না, কিছুতেই না।
ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃসমাপ্তঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ
গানটির ইউটিউব লিঙ্ক রইল । যারা শোনেননি , একবার শুনে নিন ( ইচ্ছে হলে বারবার ) ।
The vibrant city of Kolkata is set to host an extraordinary musical event as renowned Indian music…
In a heartwarming ode to friendship and the unifying spirit of Pujo, SVF Brands has…
The year 2024 has not been what I had planned so far. Everything went downhill.…
Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…
Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…
This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…
This website uses cookies.