আজ অ্যাডভোকেড ঋত্বিকা দাসগুপ্তের কাছে নতুন একটা কেস এসেছে, একটি মেয়ে প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করেছিল তার প্রেমিককে, বাড়ি থেকে মেনে না নেওয়ায় এই পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিয়ের পর স্বামী রোজ মারধর শুরু করায়,আর সহ্য করতে না পেরে..সুইসাইড করে মেয়েটি। কারণটা ওর চিঠিতে স্পষ্ট লেখা- বাড়িতে গেলে বাবাই মেরে ফেলবে।
কেসটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে বসে রইলো ঋত্বিকা, ও জানে এখন প্রায়ই চারিদিকে এরকম হচ্ছে, ঘটনাটা খুবই সাধারণ। তবুও ওর মনে পরতে থাকে অনেক কিছু।
ঋত্বিকা ছোটবেলা থেকেই খুব প্রতিবাদী মেয়ে, চুপচাপ মুখবুজে সহ্য করার মতন ও কখনোই তৈরী হয়নি..বলা ভালো যে ওকে কেউ সেরকম তৈরী হতে দেয়নি।
যেহেতু খুব ঠোঁটকাটা তাই কেউ এমন নেই যার সাথে ওর কথা কাটাকাটি হয়নি, তার থেকে ওর বাবা,মা,ঠাম্মি আর ভাইও বাদ পরেনি। সবাই ভেবেছিলো ছোট থেকেই এরকম যখন, তাহলে ওকে ওকালতি পড়ানো দরকার। উকিল হলে ঠোঁটকাটা হওয়াটা প্রয়োজনীয়।
ওকে কেউ কোনোদিন বলে নি “তুই না মেয়ে, ওতো কথা বলবি না”
হ্যাঁ, এইরকম পরিবারেই ও বড়ো হয়েছে, যেখানে মেয়ে যদি কথা বলতে জানে তবে তাকে এটা তো বলা হয়ই না যে “মেয়ে হয়ে এতো উঁচু গলা?”
বরঞ্চ ও সবসময় বাবার থেকে শুনেছে “এতো কথা বলিস তো দেখবো ঠিক জায়গায় কত বলতে পারিস.. ওকালতি পড়াবো তোকে”
ঋত্বিকা একদিন এক বন্ধুর বাড়িতে গেলো জন্মদিনের নিমন্ত্রণ পেয়ে, তখন ও ক্লাস সিক্স , সেইখানে ওকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ” বড়ো হয়ে কি হবে ঋতু?” ও উত্তরে কিচ্ছু না ভেবেই সোজা বলে দিয়েছিল – বাবার মতো হবো, তখন সবার দায়িত্ব আমার।
” তোমার তো বিয়ে হয়ে যাবে,অন্য বাড়িতে চলে যাবে তুমি, কিকরে নেবে সবার দায়িত্ব? ”
ঋতু এই কথাটা আগে কখনোই শোনেনি..ও বাড়ি ফিরে সোজা চলে গেলো মায়ের কাছে, জিজ্ঞেস করলো – মা, এটা তোমার বাড়ি নয়? আমাকে চলে যেতে হবে এই বাড়ি থেকে?
ওর মায়ের সেদিনের উত্তরটা ও সারাজীবন মনে রেখেছে , “ঋতু, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তারা অন্য বাড়িতে চলে যায়, এটা নিয়ম, এটা যেমন সত্যি তেমন এটাও সত্যি যে মানুষদের জন্য নিয়ম তৈরী করা হয়েছে, নিয়মের জন্যে মানুষ তৈরি হয়নি, তোমার তখন যেটা ইচ্ছা করবে, ঠিক মনে হবে, তুমি সেটাই করবে ”
ঋত্বিকা আসতে আসতে বড়ো হলো, ওর তখন ক্লাস ইলেভেন, ও নিজেই অনুভব করলো যে ওর স্বাধীনতার গন্ডীটা একটু একটু করে বড়ো হচ্ছে। ও এখন একা একা টিউশনস যায়, কোনো ছেলে বন্ধুর সাথে ফিরলেও বাবা বা মা কখনো প্রশ্ন করেনা।
ওরা বন্ধুরা মিলে একবার ঠিক করলো পুজোতে ঠাকুর দেখতে বেরোবে, সেদিন ওর এক মেয়ে বন্ধু বলল ” বাড়ি থেকে একা ছাড়বে নারে, দাদাকে ছাড়ে..আমাকে নয় ”
ঋতু ঠিক বুঝতে পারলো না কথাটা, ও কখনোই ভাবতে পারে না ওর আর ওর ভাই-এর মধ্যে কোনও তফাৎ আছে, তাছাড়া ও ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে ওর মা যেমন বাবা না আসা অবধি খায়না, তেমনি ওর মা কোথাও গেলে ওর বাবাও অপেক্ষা করে। ছেলে মেয়ের মধ্যে পার্থক্যটা ওকে কেউ কখনো শেখায়নি। ও যা পেয়েছে ওর ভাইও ঠিক তাই তাই পায়। বরং ওকে বলা হয়েছে বরাবর ” তোর ভাই অটো চালিয়েও খেতে পারবে বুঝলি… কিন্তু তোকে চাকরি করতেই হবে ”
ওকে ওর বন্ধুরা যখন জিজ্ঞেস করে- তুই কাকে সব থেকে বেশি ভয় পাস? ও বলে – ভূতে।
” আর বাবাকে? ”
“বাবাকে ভয় পাব কেন?”
ঋত্বিকা ওকালতি পড়তে ভর্তি হল, সবকিছু ও নিজের ইচ্ছায় করলো। ওর অনেক বন্ধু হলো কলেজে, ছেলে-মেয়ে। ছেলে বন্ধুর সংখ্যাই কলেজে বেশি, তবুও ঋতুর কোনো ভয় কখনোই লাগেনি। ও জানতো ওকে কেউ কখনো সন্দেহের চোখে দেখবে না, অঘাত স্বাধীনতা ভোগ করেও ঋতু কিন্তু গোল্লায় যায়নি, বরঞ্চ তৈরী হয়েছে একটা শক্ত চরিত্রের মেয়ে।
ঋতু যখন প্রথম প্রেমে পরলো, ওর মায়ের মুখ থেকে শুনল, ” মনে রেখো তোমার কাছে এবং আমাদের কাছে কিন্ত তুমিই আগে, অন্যকাউকেই সেই জায়গাটা নিয়ে নিতে দিয়োনা কখনো ”
কেউ জোর করে, ধমক দিয়ে ওর প্রেমটা ভেঙে দিতে চায়নি, তবে যেদিন ওর প্রেমটা ভাঙলো, ওকে লুকিয়ে কাদতে হয়নি। ওর বাবা সেদিন ওকে প্রথম বলল, ” এরকম অনেক ছেলে তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে ঋতু, তোর জন্য আমি তো আছি ”
ঋতুর কাছে ওর বাড়িটা ওর খুলে নিঃশাস নেওয়ার জায়গা…
বাকিরা যখন বলে – ধুর আবার বাড়ি।
ঋতু বলে – বাড়ি যাই রে, খুব ক্লান্ত লাগছে।
পাড়ায় কোন ছেলে ওকে কি বললো আর তার পরিবর্তে ও কোন গালাগালিটা ফিরিয়ে দিলো সেটা ঋতু এসে অকপটে বলে ফেলে মাকে, “মা জানো একটা বাজে কথা বেরিয়ে গেছিলো মুখ থেকে ”
ওর মা বলে ” বেরিয়ে গেছিলো কি বলিস রে, বেশ করেছিস ”
” এই তোর বয়ফ্রেন্ডকে একটা বাইক কিনতে বলতে পারিস না? ” ঋতুকে একদিন ওর বন্ধু এটা জিজ্ঞেস করেছিল।
ঋতু বলল – কেনো? আমার বাবা আমাকে গাড়িভাড়া দেয়, এক্সট্রা টাকাও দেয়, ওকে বাইক কিনতে বলা মানে সেটা কি আমার বাবাকে অপমান করা হবে না?
ঋতুকে কেউ কখনোই কিছুতো বাঁধা দেয়নি, বলেনি – কোথায় যাচ্ছ? দরকার নেই যাওয়ার। বারবার বলেছে ” সাবধানে যাবে, ফোন করবে”
লোকে বলে অতিরিক্ত আদরে বাঁদর তৈরী হয়.. ঋতু কিন্তু সারাজীবনে এমন কোনও কাজ করেনি যা ওর করা উচিত হয়নি। ওকে শুধু বাড়ি থেকে বলে দেওয়া হয়েছিলো কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, বাকি সমস্তই ও নিজে বেছে নিয়েছে নিজের জন্য।
যে পাখিকে খাঁচায় পুরে রাখা হয়, তারই অঘাত কৌতুহল থাকে বাইরের পৃথিবীর দিকে, সুযোগ পেলেই সে বেরিয়ে পরতে চায়, কিন্তু যে পাখি সবসময় ছাড়া..তার কাছে বিপদের দিনে ওই খাঁচাটা একটা নিরাপদ স্থান। ঋতুর কাছে ওর বাড়িই হল ওর সেই খাঁচা। ওকে কেউ বেঁধে রাখেনি, তাই জন্যই ও এতো সুন্দর ভাবে বেঁধে আছে বাড়িটার সাথে।
আজ ওই মেয়েটার বাবাকে দেখে ঋতুর রাগ তো হোলোই, করুনাও হলো… ওর বলতে ইচ্ছা করল অনেককিছু তবে ও বললো খুবই সামান্য
– কেসটা আমি নেবো না
– কেনো ম্যাডাম? আপনার পুরো ফি টাই দেব, আমি আমার মেয়ের বিচার চাই ম্যাডাম।
– যদি কেস করতেই হয় তাহলে শুধু আপনার মেয়ের স্বামীর নামে না করে নিজের নামেও একটা করুন । ওই ছেলেটাও যেমন দোষী, আপনিও কিছু কম নন, কেনো এমন একটা জায়গা তৈরী করেননি আপনি যে আপনার মেয়ে বিপদে পরলে প্রথমেই আপনার মুখ ওর মনে পরবে? কেন ও আপনার কাছে ফিরে যাওয়া থেকে মরে যাওয়াটাকে সহজ ভাবলো? শুনুন.. যে গাছটা চারা থাকা অবস্থা থেকেই পর্যাপ্ত জল, সার পায়নি..সে তো দুর্বল হবেই। মরে যাওয়ার জন্য শুধু এখন যে উপড়ে ফেললো তাকে দায়ী করবেন না, আপনিই শক্ত করতে পারেননি ওর গোড়াটা। শক্ত করলে এতো সহজেই কেউ উপড়ে ফেলতে পারতনা। কি কেস নেবো আপনার? আমি তো আপনার বিরুদ্ধেই হাজারটা যুক্তি দেখতে পাচ্ছি। বাড়ি যান, আর দয়া করে ছোট মেয়েটাকে বুঝিয়ে দেবেন..মৃত অবস্তায় বাড়ি ফেরার চেয়ে বিয়ে ভেঙে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফেরা অনেক ভালো ।
এই বলে..ঋতু ওর সেক্রেটারিকে বললো আজ আর কোনো মিটিং না রাখতে, ওর বারবার মনে পরতে থাকলো ” তোর জন্য আমি তো আছি ঋতু” ও মনে মনে ভাবলো, পৃথিবীর সব বাবাই যদি একবার করে তাদের মেয়েদেরকে বলত “তোর জন্য আমি তো আছি ” কতগুলো সতেজ প্রাণ আজ বেঁচে থাকতো এই পৃথিবীতেই।
ঋতুর ঠাম্মি ঋতুকে ছোটবেলায় অনেক রূপকথার গল্প শোনাতো, তাতে থাকতো..রাজকুমারী, বিশাল রাজ্য আর পক্ষীরাজ ঘোরা । তবে সেই ঘোরাতে করে কোনোদিন কোনো রাজকুমার আসতো না..
বারবার ঠাম্মি বলতো ” তারপর একদিন রূপকথার পক্ষীরাজ এসে.. ঋতুকে নিয়ে গেলো অনেক উঁচুতে, সেই আকাশে…তোমাকেও অতটাই উঁচুতে পৌঁছাতে হবে কিন্তু দিদিভাই “