শর্টকাট নেবেন না প্লিজ।

“সাফল্যের কোনো শর্টকাট হয় না। আর যদি তাই হত তবে মানুষের জীবনে হয়তো ‘স্ট্রাগল’ শব্দটার এত মাহাত্ম্য থাকতো না।”
“কিন্তু স্ট্রাগল না করেও যদি সাকসেস গেইন করা যায় তবে ক্ষতি কী?”
“প্রাথমিকভাবে ভাবতে গেলে এতে ক্ষতি তো নেই কোনো বরং সোনায় সোহাগা। কে না চায় বিনা পরিশ্রমে নিজেকে একটা সফল মানুষ হিসেবে গড়তে। কিন্তু এবার প্রশ্নটা হল, বিনা স্ট্রাগলে কী সাকসেস আসবে?”

“আসবে।” রণজয় আর কিংশুকের কথোপকথনে হঠাৎ করে এন্ট্রি নিল পলাশ। কিংশুক বেশ উত্তেজিত হয়েই বললো, “কীভাবে শুনি?” পলাশ বললো, “চল একটা জায়গায় নিয়ে যাই তোদের।” রণজয় বললো, “কোথায়?”
পলাশ বললো, “চল না। এসব ব্যপারে অত প্রশ্ন করতে নেই। আমি বাইকটা স্টার্ট করছি, উঠে পড়…”

জায়গাটায় পৌছাতে আধঘন্টা মতো সময় লাগলো তিন বন্ধুর। একটা সাধারণ মধ্যবিত্তের বাড়ি যেমন হয় বাইরে থেকে দেখতে, অনেকটা সেরকমই। কিন্তু ভেতরের চেহারাটা অন্য। বসার ঘরটা প্রায় অন্ধকার। একটা লাল রঙের বাল্ব জ্বলছে শুধু। সম্ভবত অনেকদিন জানালা খোলা হয় না ঘরটার। একটা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ চারিদিকে। সোফায় দুজনকে বসতে বলে পলাশ ভেতরের ঘরে গেছে তাও দু’মিনিট হতে চলল। কিংশুক আর রণজয় একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়াই করছে এমন সময় ডাক পড়লো দুজনেরই। ভেতরের ঘরটা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। পলাশ ছাড়াও সেখানে আরও দুজন আছে। তারমধ্যে একজন চোখ বন্ধ করে ধ্যানমগ্ন।
পলাশ তার দিকে ইশারা করেই বেশ মৃদু ভাবে বললো, “নে প্রণাম কর। ইনি দুঃখনাশক বাবা। হিমালয় পর্বতে তেত্রিশ বছর তপস্যা করে শক্তি পাওয়ার পর অবশেষে এখানে এসে ভক্তদের দুঃখ কষ্ট দূর করার দায়িত্ব নিয়েছেন। ইনিই পারেন হাতের মুঠোয় তুড়িতে সাফল্য এনে দিতে।” কথাটা শুনে রণজয় ফিক করে একটু হাসলো, তবে কিংশুক কিন্তু বেশ শ্রদ্ধার সাথেই প্রণাম করলো দুঃখনাশক বাবাকে।

***

এরপর থেকে গল্পটা সবার। কেউ কেউ এসব দেখে রণজয়ের মতো ফিক করে হাসে, কেউ কেউ আবার কিংশুক আর পলাশের মতো দুঃখনাশক বাবাদের অন্ধভক্ত হয়ে যায়। কেউ কেউ কোন হিমালয়ের চূড়া, কেমন ধরনের শক্তি, তুড়িতে কীভাবে সাফল্য এনে দেওয়া যায় এসব প্রশ্ন করে বসে স্বয়ং দুঃখনাশক বাবাদেরই, কেউ কেউ আবার নিকট বন্ধু কিংবা আত্মীয়দের কথায় গলে গিয়ে বিশ্বাস করে নেয় সবটা, সাফল্যের লোভে ঝুঁকে যায় অন্ধবিশ্বাসের দিকে।

একশো সাতাশ কোটি মানুষের এই দেশ ভারতবর্ষ। সার্ভে বলছে শুধু এই ভারতবর্ষেরই মোট ৬১% মানুষ অন্ধবিশ্বাসী। অর্থাৎ প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন শুধু রণজয়ের মতো হয়। বাকি দুজন পলাশ কিংবা কিংশুকের মতো সুপার্সটিশিয়াস। সুতরাং অন্ধবিশ্বাসী ভারতবাসীর সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় চুয়াত্তর কোটি! সেই হিসেবে দেখতে গেলে দুঃখনাশক বাবারা অন্যের দুঃখ কষ্ট দূর করতে পারুক চাই না পারুক তাদের নিজেদের যে দুঃখ থাকার কোনো কারন নেই তা প্রায় পরিস্কার।

অন্ধবিশ্বাস মানুষকে ভেতর থেকে ভঙ্গুর করে তোলে। মানুষের মনে ভয়ের সঞ্চার আনে অন্ধবিশ্বাস। আর এই ভয়ের সুযোগ নিয়েই সারা প্রথিবীজুড়ে আজ রমমিয়ে চলছে ভক্তির নামে ব্যবসা। ঈশ্বরের নামে মানুষকে ভয় দেখিয়ে ভীতু করে, কিংবা লোভ দেখিয়ে লোভাতুর করে আজ এই ব্যবসা থেকে আয় হচ্ছে কোটি কোটি কোটি টাকা। পকেট গরম হচ্ছে দুঃখনাশক বাবাদের। বদলে সেইসব ভীতু বা লোভী মানুষদের মিলছে একখানা তাবিজ কিংবা কবচ, যা দিয়ে কীভাবে সাফল্য কীভাবে আসবে মানুষ কস্মিনকালেও বুঝতে পারে না।

আপনি বুঝতে পারছেন, অথচ বলতে পারছেন না। প্রতিবাদ করবেন ভাবছেন অথচ প্রতিবাদ করতে পারছেন না। কারন একদিকে আপনার লোভ, আরেকদিকে ভয়।
এই লোভ আর ভয় আপনাকে অনবরত ঠেলে দিচ্ছে এই অন্ধ ভক্তির দিকে। আপনি গলায় তাবিজ পড়েই সাফল্য আশা করছেন, কারণ অমুক এসে বলেছিল তমুক নাকি এভাবেই চাকরীটা পেয়েছে।
একদিকে আপনার যেমন চাকরী না হওয়ার ভয়, আরেকদিকে তেমন তমুকের মতো সফল হওয়ার লোভ- এই দুইয়ে মিলে আপনাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে রোজ। নেপথ্যে সেই শর্টকাট।

এর চাইতে একবার রণজয়ের মতো হয়েই দেখুন না। ফিক করে হাসুন। প্রশ্ন করুন। শর্টকাটে সাসকেসফুল হওয়ার ইচ্ছেটা বাতিল করুন মন থেকে। স্বপ্নের জন্যে লড়ুন, বাঁচুন, স্ট্রাগল করুন। কেনা আমের চাইতে গাছ থেকে নিজের পেরে নেওয়া আম কিন্তু অনেক অনেক বেশি মিষ্টি। ভয় আর লোভে কুঁকড়ে গিয়ে অযথা শর্টকাট নেবেন না প্লিজ।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *