শুকনো পাতার নূপুর পায়ে

শীত মানেই শুকনো পাতার সমারোহ। রাস্তায় দুপাশে ছড়িয়ে থাকা শুকনো পাতারা অবহেলা নিয়ে যেন জমা হয় এদিকওদিক। এই গল্পটা এমনই একটা শীতের শুষ্ক দিনে কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে কখন যেন শুরু হয়েছিলো মেঘা নিজেও জানেনা। 

ক্রিস্টমাসের ছুটিতে বাড়ি ফিরেছে মেঘা। হোস্টেল থেকে প্রতিবার এইসময় সে বাড়ি আসে একমাসের ছুটিতে। চারদিক যেন বড় শুকনো থাকে এইসময়। যদিও পাহাড়ী অঞ্চলে তার কনভেন্ট স্কুল আর হোস্টেল হওয়ায় সমতলে এসে ওর তেমন ঠান্ডা লাগেনা। স্বাভাবিকভাবে পাহাড়ে এমন ঠান্ডায় সারাবছর সে অভ্যস্ত। মালদায় বাড়িতে ওর জন্য অপেক্ষা করে থাকে অনেকে। ওর মা-বাবা-ঠাম্মা ছাড়াও সেই তালিকায় আছে সিঞ্চন। মেঘার রুক্ষ, শুষ্ক জীবনে সিঞ্চন যেন সমতলে বয়ে চলা পাহাড়ী নদী। মেঘা নিজে সারাবছর অপেক্ষা করে আছে সেই নদীর পাশে বসার জন্য। সিঞ্চন ওর ছোটবেলার বন্ধু, যদিও বয়সে খানিক বড়। 

এইবার বাড়ি ফেরার পর সিঞ্চন আসেনি এখনো অবধি। সিঞ্চনের সাথেই ও আশেপাশে ঘুরতে চলে যায় এই সময়। নাহলে এই বাড়িতে সকলে খুব ব্যস্ত। তাইতো বাড়ির একমাত্র আদুরে মেয়েকেও পাঠাতে হয়েছে দূর পাহাড়ে নামকরা স্কুলের হোস্টেলে। তবে এইসময় ছুটিতে ওকে সময় দিতে চেষ্টা করে মা আর বাবা দুজনেই। ঠাম্মা ওকে খুব ভালোবাসে, তিনি চাননি ও এভাবে বড় হোক। এইবার ও বোর্ড এক্সাম দেবে, ও নিজেকে যথেষ্ট বড় মনে করে, নিজের মতো থাকে। তবে দার্জিলিং যাবার সময় যতটা শুকনো মুখে বুকে কষ্ট নিয়ে গেছিলো, যাবার পরে এতগুলো বছরে ওই শহর মেঘাকে অনেককিছু দিয়েছে। গতবার ফেরা থেকে সিঞ্চনের সাথে ওর বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়েছে যদিও ওর মা সেটা পছন্দ করেনি। অপেক্ষা করছে ও কখন সিঞ্চন আসবে! 

” দিদিভাই, মুখটা শুকনো লাগছে কেন? ” 

” না ঠাম্মা কিছু নয়! ” 

” তোমার বয়সটা আমিও পেরিয়ে এসেছি। সিঞ্চনের জন্য অপেক্ষা করছো তো… ” মেঘা আর মিথ্যে বলেনা। ” হুমমম। আসছেনা কেন কে জানে! ” 

“আসবে, আসবে, ঠিক আসবে। সেতো জানে তুমি এসেছো। বছরে এইসময়েই দেখা হয়। না এসে যাবে কোথায়! ” ঠাম্মা বলেন। মেঘার ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে।

 

বিকেলে সিঞ্চন আসে। ” কি রে কেমন আছিস পুচকি? ” ” তুমি আমাকে খবরদার পুচকি বলবেনা। তোমার এই আসার সময় হলো! ” ” আরে কলেজ করে ফিরলাম। কাল তোকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। “

সংগৃহীত

পরেরদিন দুজনে বেরিয়ে পরে। মালদার রাস্তায় রাস্তায় দুজনের পায়ের ছাপ ছড়িয়ে থাকে পাতাঝরার মরশুমে। শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে থাকে মেঘার মন। সিঞ্চনের শুষ্ক মনেও প্লাবন আসে এইসময়। সে বলে, ” এই শীতকাল আমার সবচেয়ে প্ৰিয়। ” ” কেন! নলেনগুড়ের রসগোল্লা পাওয়া যায় বলে?” ” নাহ! এই শুকনো দিনে তুই পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসিস বলে! “

ফেরার পথে সিঞ্চন একজোড়া পায়েল পরিয়ে দেয় মেঘার পায়ে। পায়েলটায় পাতার মতো ডিজাইন করা রয়েছে। সিঞ্চন বলে ওঠে, ” যেদিন তুই অনেক বড় হয়ে যাবি, আর আমার কথা তোর মনে পড়বেনা সেদিন এই নূপুরের পাতা শুকিয়ে যাবে। শুকনো পাতার নূপুর পায়ে তুই অনেক দূরে চলে যাবি… ” মেঘার অন্যরকম লাগে এই সিঞ্চনকে। হাসিখুশি ছেলেটার চোখে যেন শুষ্ক বিষন্নতা।

সংগৃহীত

মেঘা বলে ওঠে, ” আমার যখনি ক্লান্ত লাগবে তখনি আমি শুকনো পাতা মাড়িয়ে তোমার কাছে ফিরে আসবো। পাতা জমা হয়ে হলুদ হয়ে যাওয়া রাস্তায় আমরা পাশাপাশি হাঁটবো। কোনো একদিন বরফঢাকা শহরে ঘুরতে যাবো আমরা।” মেঘা মনে মনে ভাবতে থাকে, সিঞ্চন জানেনা যে সে এক পাহাড়ী উদ্দাম নদী যার পাড়ে বসে সব ক্লান্তি ভুলে যাওয়া যায় নিমেষেই! তারজন্য চিরকাল পাহাড় থেকে নিচের সমতলে ফিরে আসা যায়… 

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *