অপেক্ষা

আজ আর ভালো লাগছে না। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামবে। পড়ন্ত সূর্যের আলো সামনের ঐ ভিড় পেরিয়ে এসে লাগছে বাচ্চার চোখে। দোকানে বসে আছে বাচ্চা। প্রতিদিনের মতো আজও ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন দোকানে এলো। চার পাঁচ রকমের মধ্যে থেকে একরকম ধূপকাঠি পছন্দ করে নিয়ে গেল। যাওয়ার পথে আরও একবার পিছনে ফিরে এসে কিছু ফুলও নিয়ে গেল।
ব্যাস! এটাই লাস্ট কাস্টমার। এবার বনমালী আসবে। সন্ধ্যা ছ’টা থেকে ভোর পর্যন্ত বনমালী দোকান সামলায়। আবার ভোর পাঁচটা থেকে বাচ্চার ডিউটি। শ্মশান বলে কথা, দোকান ২৪ ঘন্টাই খোলা রাখতে হবে। কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে দোকানের মালিক দুলাল দত্তের। সে মাঝে মাঝে দোকানে আসে। বাকি সময় বাচ্চা আর বনমালী দেখাশোনা করে।
বনমালী বাচ্চার থেকে বয়সে বড়ো। সে পুরুলিয়ার ছেলে। এখন কলকাতাতেই সারা বছর থাকে। আর বাচ্চার বাড়ি করঞ্জলি। কলকাতাতে মেজো মামার কাছে থাকে। বাচ্চার বাবা মা যখন মারা গেল, তারপর মামা তাকে কলকাতা নিয়ে আসে। পড়াশোনা শেখেনি বাচ্চা। ঐ গ্রামের প্রাইমারি ‘ইস্কুলে’ ক্লাস 1 এ ভর্তি হয়েছিল সে। তখন তার একটা নামও ছিল, “গোবিন্দ প্রামাণিক”। কিন্তু এখানে কেউ তাকে এই নামে চেনে না। সবাই বাচ্চা বলেই ডাকে। তেরো বছরের ছেলেটার মনে নাম নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। শুধু মাঝে মাঝে তার মনে হয় তার মা বাবাও যদি এতো বড় একটা শ্মশানে পুড়ত, তাহলে হয়তো তাদের আকাশের তারা হয়ে থাকতে হত না। তার মনে আছে পাশাপাশি দু’টো দেহ আগুনে জ্বলছিল তাদের গ্রামের শ্মশানঘাটে। গ্রামের সবাই দেখছে। সে নিজে হাতে আগুন দিয়েছে বাবা মায়ের মুখে। তখন আগুনে খুব কষ্ট হচ্ছিল ওদের।
সেই দৃশ্য মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে তার চোখে। ঘুম ভেঙে যায়। মামাবাড়ির বারান্দায় উঠে বসে সে। বাইরে কল থেকে চোখে মুখে জল দিয়ে আবার বারান্দায় পাতলা চাদরের উপর শুয়ে পড়ে। কখনও ঘুম আসে কখনো বা আসে না। কত আকাশকুসুম ভাবে ছেলেটা। আকাশ পরিষ্কার থাকলে তারাদের দেখে সে।
এভাবেই ভোর হয়। আবার দোকান সামলানোর পালা। প্রতিদিন কত মানুষ আসে শ্মশানে। কেউ কেউ ফিরে যায়, আর কেউ কেউ যায় না। এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বাচ্চা। প্রতিদিন সে কত মানুষ দেখছে। বিভিন্ন ধরণের মানুষ। কিন্তু এই ছোট্ট বয়সে সে বুঝে গেছে, এই পৃথিবীতে কেউ কারোর জন্য অপেক্ষা করে না। চুল্লিতে ঢোকানোর পর সবাই ঘড়ি দেখতে থাকে। ফিরে যাওয়ার তাড়া। হয়তো সেই মুহূর্তেই মৃত মানুষটির প্রয়োজন শেষ হয়ে যায় সকলের। কেউ পিছনে ফিরেও তাকায় না।
বাচ্চা অপেক্ষা করে মৃতের। আর প্রতিটা মৃত মানুষ “বাচ্চাদের” বেঁচে থাকার কারণ হয়ে ওঠে।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *