- ” অমৃতা তখনো অভ্যাস বশত এলোমেলো চুলের মধ্যে দিয়ে আঙুল চালিয়েছিল। ওর চোখের সামনে দিয়ে এলোমেলো আলোর বিন্দু চলে বেড়াচ্ছিল। সব কিছুই দেখছিল কিন্তু কিছুই দেখা হচ্ছিল না। কথাটা তখন কানের মাঝখান থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। কান থেকে কথাটা ঝড়ের বেগে কাঁধ বেয়ে, শিরদাঁড়া হয়ে যখন পায়ে নামলো, অমৃতা দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। গোটা মেট্রো স্টেশনটাকে ওর একটা অন্ধকার মৃত্যু সুড়ঙ্গ বলে মনে হলো। কোথায় যাবে ও এখন? কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে? সব কিছুই তো পিছনে ফেলে এসেছে। যেমন করে একটা এরোপ্লেন রানওয়েতে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ করে মাটির উপর নির্ভরতা ছেড়ে বেরিয়ে আসে, তারপর সামনে থাকে শুধু অসীম আকাশটাকে ছোঁয়ার ইচ্ছা, তেমন করেই অমৃতাও বেরিয়ে এসেছিলো। আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়াতে বাড়াতে হঠাৎ করে সব্বাইকে পিছনে ফেলে উড়ে গিয়েছিল শেষ এবং একমাত্র স্বপ্নের পিছনে। আজ অমৃতার ডানা ভেঙ্গে গেছে। ওর স্বপ্ন কে ছোঁয়ার ক্ষমতাও আজ হারিয়ে ফেললো। এরোপ্লেন ভেঙ্গে পড়ার সময় যত তাড়াতাড়ি পৃথিবী তাকে বুকে টেনে নিতে চায় মৃত্যু সজ্জার আঁচল পেতে, মেট্রো স্টেশনটাও তত তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল ওর কাছে। অন্ধকার মৃত্যু সুড়ঙ্গের মধ্যে ও ডুবে যাচ্ছিল।”
এতটা লেখার পর শিঞ্জিনি ভাবলো, গল্পটা কোনদিকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে? আদতে অমৃতার কী হয়েছে, সেটা পাঠককে জানানো উচিৎ। আর ওর লেখার স্বভাবই হচ্ছে যে, মাঝখান থেকে লেখা শুরু করে তারপর বাকি অংশগুলো শেষ করে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই ও এইরকম একটা প্যারার পর আর শেষ শুরু কিছুই লিখতে পারে না। এরকম কত যে আধা গল্প লিখেছে, তার হিসাব ওর ডায়রিই জানে। শিঞ্জিনি নিজের গল্পের মধ্যে নিজের সত্ত্বার কিছু না রেখে লিখতে পারেইনা। সব গল্পের মধ্যেই ও নিজেই কিছু না কিছু হয়ে উপস্থিত থাকে। তারপর গল্পের একটা পর্যায়ে গিয়ে নিজেকে আর খুঁজে না পেয়ে, লেখা বন্ধ করে দেয়।এই অমৃতার অসমাপ্ত বেখাপ্পা ফ্রাস্ট্রেটেড গল্পটার উদ্ভবের কারণ হল— শিঞ্জিনির বান্ধবী দেবলীনা আর তার প্রাক্তন স্বামী, সায়ান।
আজ ওদের ডিভোর্স হলো। দু’বছরের বিয়ের শেষে একে অপরের মানসিকতা মানিয়ে নিতে না পেরে ওরা আলাদা হয়ে গেল। আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্তটা যদিও দেবলীনার ছিল, তবুও ভিতর থেকে যে ভীষণ রকম ভেঙে পড়েছিল, সেটা শিঞ্জিনি বুঝেছিল। বাড়ির অমতে বিয়ে করে ডিভোর্সি হওয়ার কষ্টটা যে কতটা মারাত্মক, সেটাও শিঞ্জিনি জানত। দেবলীনা প্রথম থেকেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। মধ্যবিত্ত জীবন কাটাতে কাটাতে হাপিয়ে উঠে ও মরিয়া ছিল উচ্চবিত্ত হওয়ার। সায়ানকে নিয়ে ও অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। ভেবেছিল সায়ানের ডানায় ভর করে ওর স্বপ্নগুলো সত্যি করে নেবে। কিন্তু সায়ান একটা সাধারণ জীবন চেয়েছিল। যেখানে প্রয়োজনটুকু মিটে গেলেই হলো, আতিশয্যের প্রয়োজন নেই। তাই সায়ানের ভাড়ার ফ্ল্যাট, রোজকার ম্যাড়ম্যাড়ে জীবন ছেড়ে দেবলীনা বেরোতে চেয়েছিল। যেমন করে বাপের বাড়ির সবাই কে ছেড়ে ও বেরোতে চেয়েছিল। সারাজীবনের মত।
আজ কাগজপত্রে সই করার সময় শিঞ্জিনি ছিল দেবলীনার সাথে। একবারও সায়ানের দিকে তাকায়নি দেবলীনা। দাঁত চেপে কর্তব্য পালন করেছে। আর সায়ানের তো কাঁদকাঁদ অবস্থা ছিল। দুজনের মনই পড়তে পেরেছিল শিঞ্জিনি। তাই ওদের কষ্টটা ওর মধ্যেও সেঁধিয়ে গিয়েছিল। দেবলীনা-সায়ান এরপর কী করবে, এটা ভাবতে ভাবতেই দেবলীনার সাথে ফিরছিল। তারপর মেট্রো স্টেশনে ঢোকার পর যখন দেবলীনা হু হু করে কাঁদতে আরম্ভ করল, তখন শিঞ্জিনি বুঝলো আজ দেবলীনার একটা ডানাই ভেঙ্গে গেল। আবার ওকে প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। নতুন করে শুরু করতে গিয়ে, ও আবার আকাশ ছুঁতে পারবে কিনা, সেটা নিয়ে সন্দেহটা দেবলীনার কান্নার মধ্যেই প্রকাশ পাচ্ছিল।
দেবলীনার জন্যই গল্পটা লিখছিল শিঞ্জিনি। কিন্তু গল্পের শুরুটা জানা থাকলেও, শেষটা জানা নেই ওর। তাই গল্পটা শেষ করা আর ওর হয়ে উঠলো না।
আসলে অমৃতা, দেবলীনা, এমন কি সায়ান ও সারাজীবন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। এরা জীবনের কোনো একসময় লক্ষ্যর দিকে চোখ রেখে হাঁটলেও,ভুল দিকে হাঁটে। তাই একসময় দেখা যায় যে লক্ষ্য থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে সবাই। লক্ষ্যে ফিরতে হলে আবার পুরানো পথে ফিরে যেতে হবে। যেটা সব সময় সম্ভব হয়না।
তাই, অমৃতার মতো অনেকেরই সমগ্র জীবনটাকেই মৃত্যু সুড়ঙ্গ বলে মনে হয়। যে সুড়ঙ্গটার শেষ হয়েছে মৃত্যু নামক স্টেশনে।