‘আধুনিকতা’ শব্দটি বর্তমান সময়ের বহুল প্রচলিত শব্দের মধ্যে একটি। আমরা আধুনিক, আমাদের সমাজ আধুনিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী এমন অনেক কথাই আমরা প্রায়শই শুনতে পাই। এক্ষেত্রে প্রথমেই জানা দরকার আধুনিকতার প্রধান অর্থ কি বা আধুনিকতা বলতে আমরা কি বুঝি।
আধুনিকতাবাদ হল এমন একটি কৌশল, চিন্তাধারা, আলোচনা, সৃজনশীল কাজ বা শিল্প ও সাহিত্য জানার মাধ্যম যা ধ্রুপদী ছাঁচ কে ভেঙে বা কাটিয়ে নতুন আঙ্গিকে সবকিছু বিবেচনা করতে সহায়তা করে। আধুনিকতা শিল্পের বা সাহিত্যের আরোহী ও অবরোহী পদ্ধতিগুলি থেকে বিরতি বা মুক্তি দেয়।
আমাদের বর্তমান সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আধুনিকতা শব্দটির স্পর্শ বিরাজমান আর সেই সমাজের বসবাসকারী মানুষরা হল আধুনিকতার মূল ধারক ও বাহক। মূলত আধুনিকতা বেশিরভাগক্ষেত্রেই মানুষের কাছে এক আর্শীবাদ স্বরূপ; যা মানুষের জীবনধারণের পথ অনেকাংশেই মসৃণ করে তুলছে। বর্তমানে করোনা আবহে এই আধুনিকত্বের স্পষ্ট নিদর্শন হয়তো আমরা অধিক পরিমাণে লক্ষ্য করছি। পূর্বের তুলনায় এখন মানুষের শিক্ষাগ্রহণ, কেনাবেচা তথাপি জীবনধারণের প্রায় বেশিরভাগ বিষয়ই প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে।
চিত্র : সংগৃহীত
তবে শুধুমাত্র শিক্ষাক্ষেত্রে – স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নত পরিষেবা, রকমারি পোশাক পরিধান, স্মার্ট ফোনের ব্যবহার করতে পারলেই কি একটা সমাজ ও সেখানকার মানুষজন আধুনিক হয়ে ওঠে? যে সমাজের মধ্যে আজও মেয়েরা বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা, ধর্ষণ, নারী অবনমন ও অবহেলার শিকার; যেখানে আজও মেয়েদের পণ্য মনে করা হয় সেই সমাজ কী আদেও আধুনিক? অথবা যেখানে একটা ছেলের সরকারী চাকরির তকমা তাকে ভাল ছেলে বানায়, তাকে বিবাহ উপযোগী বস্তুতে পরিণত করে কিংবা যেখানে প্রতিনিয়ত বেশকিছু পুরুষের ভুল কাজের জন্য সমগ্র পুরুষজাতিকে বাজে কথা শুনতে হয় সেটা কী আমাদের প্রকৃত আধুনিকতা চরিতার্থ করে? নারী – পুরুষ সমানাধিকার, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কুরূপ ইত্যাদি নিয়ে পক্ষে – বিপক্ষে বহু মতামত থাকলেও নারী ও পুরুষদের সঠিক লক্ষ্যস্থাপনের পদ্ধতিগুলি বর্ণনা করার মধ্যে দিয়েই কী আধুনিকতা প্রমাণ করা যায় না? যে সমাজে আজও গায়ের রং (কালো বা ফর্সা) নিয়ে চূড়ান্ত বিতর্ক ও প্রতিবাদ হয়, যেখানে রূপান্তরকামীদের নিয়ে বা সমকামিতা নিয়ে হাসাহাসি করা হয়, সমাজের মূলস্তরে আসতে যাদের আজও একাধিক বাঁধা পেরাতে হয় সেই সমাজ কী সত্যিই আধুনিকতার বাহক? আচ্ছা শিক্ষক – শিক্ষিকাদের, বয়স্কদের প্রাপ্ত সম্মান না দিয়ে তাদের সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করা, গালিগালাজ করাই কী আধুনিকত্ব? আর যারা প্রতিটা বিষয়ে অন্যের সমালোচনা করে অন্যদের সবার সামনে অপদস্থ করে, সর্বদা অন্যের ভুল – ত্রুটি খুঁজে বেরায় কিন্তু আঘাতপ্রাপ্ত মানুষগুলো যখন তার প্রতিবাদ করে তখন সেই সমালোচকদের বিকৃত মন্তব্য ও অযাচিত হাসি কী তাদের আধুনিকমনস্কতার পরিচয় বহন করে? কিংবা নির্বিচারে পশু হত্যা, পশুদের উপর নানাবিধ শারীরিক অত্যাচার তাদের অকাল মৃত্যু কী আধুনিকতার নব রূপ নাকি সেই আদিম যুগের মানুষের মতো বর্বরতার ধারাবাহিকতা?
আচ্ছা একবার ভেবে দেখুন তো এই প্রশ্নের উত্তরগুলো কী সত্যিই অধরা? আমরা কী সত্যিই আধুনিকতা মানে জানি? কতটা আধুনিক আমরা? আধুনিকতার পরিসর কী বড়ই সীমিত? না! আমরা সফল আধুনিকতার দাবীদার এখনও হয়ে উঠতে পারিনি; আমরা এখনও বেশকিছুটা আধুনিকত্বের মায়াজালেই আবদ্ধ। আধুনিকতা বা আধুনিক শব্দের বিস্তার বহুদূর, আধুনিক শব্দটি পরপর কয়েক দশকের মানুষ ও পারিপার্শ্বিকের অগ্রগতির চরম পর্যায় হিসাবেই বিবেচিত হয়। যেখানে মানুষ তথা সমাজের বাহ্যিক পরিবর্তনটাই আধুনিকতার পরিচায়ক না হয়ে; মানুষের নব নব চিন্তাধারা, মানবিকতা, মানসিকতার উন্নয়ন ঘটার মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠতে পারে মানসিক চিন্তাধারার আধুনিকত্ব। যেখানে মানুষ শুধুমাত্র সুবিধা পাওয়ার আশায় নয়, একে অন্যের সহানুভূতি, সৌদার্হ্যপূর্ণ আচরণ দিয়েও সমাজে আধুনিকত্বের আহ্বান জানাতে পারে আর যেদিন সেটা সম্ভব হবে সেদিন প্রকৃত অর্থেই মানুষ, সমাজ ও সভ্যতা আধুনিক হয়ে উঠবে।