আমরা বাঁচতে চাই…
ফতিমা আজ বড্ড ব্যস্ত, কারণ সময়টা রমজান মাস। ঈদের সময়। ফতিমার বাড়িতে তখন উৎসবের রঙ লেগেছে। রঙবেরঙের ফুল, মালা আর ঝাড়বাতিতে সেজে উঠেছে ওদের প্রাসাদ সমান বাড়িটা।
ফতিমা, বছর দশেকের ফুটফুটে প্রাণোচ্ছল এক পাহাড়ি ঝরনা। দাদা-দাদি, আম্মি-আব্বু, বুয়া আর ছোটো ভাই রাকিব— এদের সবাইকে নিয়ে তার সুখী পরিবার।
ঈদের দিন। তাই বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের ভিড় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সারা বাড়িতে লোকজন গমগম করছে।
অন্যদিকে আবার বিরিয়ানি, পোলাও, চাপ, কাবাব, কুলফিমালাইয়ের গন্ধে গোটা বাড়ি ম ম করছে। আর বাড়িটা যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে ছোটোদের হাসির কলরোলে।
ওইদিন সন্ধ্যেবেলা ফতিমার বাবার বন্ধু রহমত আলি, মানে ওদের রহমত চাচা ঠিক করল ছোটোদের নিয়ে ঈদের মেলায় যাবে ঘুরতে। ওদের বাড়িতে প্রথম এসেছে, বাড়ির অতিথিও বটে, তাই বড়োরাও অগত্যা নিমরাজি হয়ে অনুমতি দিল মেলায় যাওয়ার। আর ছোটোরাও সানন্দে চলল চাচার হাত ধরে ঈদের মেলায়।
সেখানে নাগরদোলা থেকে বুড়ির চুল, বাদাম ভাজা থেকে জিলিপি— সবটুকু প্রাণ ভরে উপভোগ করল ওরা। তবে সে উৎসবের রাত আর কিছু সময়ের মধ্যেই বয়ে এনেছিল অভিশাপ। সে রাতে ফতিমার আর বাড়ি ফেরা হয়নি, বাড়ি ফেরেনি বাকিরাও। রহমত আলির খোঁজও পাওয়া যায়নি আর কোনোদিন।
…শোনা যায় লাল গলিতে নাকি কচি নরম মাংস বেশী দামে বিকোয়। তাই ফতিমা, রাজিয়া, রাবেয়াদের শরীর ওখানে রোজ রাতে বিক্রি হয় ১০০০ টাকা প্রতি ঘন্টার দরে…
রমেনের বাড়ি মেদিনীপুর। ওরা ৪ ভাইবোন। রমেন সবার বড়। ওর বয়স ১৪, আর সবার ছোটো বোনটা সবে ১ বছর ৯ মাস। ওর বাবা ট্রেনে হকারি করতো। নিয়তির ফেরে চলন্ত ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে ওর বাবা।
বাবা মারা যাওয়ার পর মা দু’বাড়িতে ঠিকে কাজ নিয়েছে। যা পায় তাতে তাদের পাঁচটা পেটের নুন-ভাতটুকু জুটে যায়। কিন্তু রমেনের চোখে যে প্রচুর স্বপ্ন। সে যে বড়ো দাদা, তার যে প্রচুর কর্তব্য। তার স্বপ্ন তার বোনেরা বড় হবে, পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হবে। কিন্তু তার জন্য যে দরকার অনেক টাকা, তাই সে ঠিক করল সে শহরে যাবে, কাজ খুঁজবে, কাজ করবে।
পাশের পাড়ার রতন কাকা বলল কলকাতা শহরে নাকি তার পরিচিত কে একজন আছে, যে রমেনকে কাজ দিতে পারে।
চাকরির আশায় রতন কাকার হাত ধরে রমেন পা রাখল শহরে। নতুন শহর, নতুন পরিবেশ— সবই তার অচেনা। তার পাড়ার ওই ভদ্রলোক ওকে নিয়ে গেল তার বন্ধুর বাড়ি।
কাজটা হয়ে যাবে— এই আশায় রাতের নৈশভোজটা ওখানেই সেরে ঘুমাতে গেল রমেন। কিন্তু পরেরদিন সকালে নতুন শহরের নতুন দিনের নতুন সূর্য তার আর দেখা হল না।
কলকাতার কিডনি পাচারকারীদের সাথে আপোষ ছিল রতনবাবুর। ঘটনার পরে ফেরার হয়ে যান তিনি, আর রমেনের পরিবারের কাছেও মামলা চালানোর মত টাকা ছিলনা, তাই কেসটা শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়, আর অন্যদিকে সন্তানহারা হন আরেক মা।
…রমেনের পচাগলা লাশটা পাওয়া গেছিল দু’দিন পরে, ভাগাড়ের পাশের পচা নালাটার ধারে। পেটের কাছটা চেরা ছিল, সেলাইটুকু করার সময়ও হয়নি, চোখ দুটো বোধহয় খুবলে খেয়েছিল চিল বা শকুন। না, ওর পরিবার দেখেনি ওর সেই অন্তিম পরিণতি…
অনিকেতবাবু একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী। রাজারহাটে দু’কামরার ফ্ল্যাটে স্ত্রী লীনা দেবী আর ছোট্ট মেয়ে রিমলিকে নিয়ে তাঁর বাস। গত মাসেই রিমলি ৪ পূর্ণ করে ৫-এ পা দিল। ভারী মিষ্টি মেয়েটা। যেমন আদো আদো কথা, তেমনি মুখখানা দেখেও মেলে এক অদ্ভুত শান্তি।
সেদিন রিমলি স্কুলে গেছে। হঠাৎ লীনা দেবীর কাছে ফোন আসে অনিকেতবাবুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে এবং জখম গুরুতর। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হতে তিনি দুর্ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। ওদিকে রিমলির স্কুলও ছুটি হয়ে যায়। স্কুলের দারোয়ানের কাছে ওর বাবাইয়ের বন্ধুর পরিচয় দিয়ে কয়েকজন কিডন্যাপ করে রিমলিকে। না, তখন পুলিশি তৎপরতাও দেখতে পাওয়া যায়নি বা কিডন্যাপারদের ফোনও আর আসেনি। ওদিকে অনিকেতবাবুর অ্যাক্সিডেন্টের খবরটাও ভুয়ো ছিল। রিমলিকে আর খুঁজে পায়নি তার মাম্মাম আর বাবাই।
…সেদিন রিমলিকে ক্লোরোফর্ম শুকিয়ে কিডন্যাপ করার পর বেনারসে নিয়ে গিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হয় তাকে। রিমলির বয়স এখন ৮। বেনারসের গঙ্গার ঘাটে রিমলি এখন ভিক্ষা করে। তার হয়তো মনেও পড়েনা তার মাম্মাম কিংবা বাবাইকে…
প্রতি ৮ মিনিটে এভাবেই বিশ্বের কোথাও না কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে এমনি ফুটফুটে ফতিমা, রমেন, রিমলিরা। জীবন শুরু হওয়ার আগেই তারা মিলিয়ে যাচ্ছে কোনো এক চোরা পথের বাঁকের অন্ধকারে… এর জন্য দায়ী ঠিক কে? দারিদ্রতা নাকি প্রশাসনের দায়সারা ভাব? শিক্ষার অভাব নাকি আইনি গাফিলতি নাকি দুর্বল পুলিশি ব্যবস্থা? সঠিক উত্তরটা হয়তো কারোরই জানা নেই।
গোটা বিশ্বের নিরিখে Child Trafficking বা শিশু পাচারে ভারত প্রথম স্থান অধিকার করে, দ্বিতীয় স্থানে নেপাল আর তৃতীয় স্থানে বাংলাদেশ।
একটু তলিয়ে ভেবে দেখলে যারা এই কাজগুলো করছে তারাও কিন্তু আমাদের মতোই মানুষ, তবে “মান” আর “হুঁশ”-এর অধিকারী নয় সেটা আলাদা ব্যাপার। অবশ্য ভালোভাবে খতিয়ে দেখলে কালো মাথার ভিড়ে প্রকৃত মানুষ হয়তো পাওয়া যাবে হাতে গোনা। তাই আজ “বিশ্ব মানবাধিকার দিবস“-এ আসুন শপথ গ্রহণ করি মানুষ হওয়ার, প্রকৃত মানুষ। একটা ন্যূনতম চেষ্টা তো অন্তত করতেই পারি যাতে রিমলিরা হারিয়ে না যায়, কারণ ওরাও বাঁচতে চায়…