আচ্ছা কখনো ভেবেছেন? আপনার জীবনের বেশ খানিকটা সময় জানলার ধারে বসেই কেটে যায়। সে বাসে জানলার ধারে সিট পাওয়ার জন্য হোক বা পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার একটা মাধ্যম হিসেবেও হোক। ছোট থেকে আমরা বড় হই, আমরা বদলে যাই, কিন্তু ঐ জানলার মধ্যেকার সময়গুলো এখনও উঁকি মারে যে…
একটা সকালে—
আমি একলা একটা জানলার ধারে চুপ করে বসে আছি, জানি না হয়তো একলা সময় কাটাবো বলে। আসলে এই জানলা রোজ সকালে কিছু আলো ঢোকে, ভোরের ঠান্ডা বাতাস আমার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টায় কত কি না করে। ছোটবেলার সকালটা না, একটু আলাদা হয়, একটু অন্যরকম। সকালে মায়ের ডাকে ঘুম থেকে ওঠা, ঘুমঘুম চোখে জানলার দিকে তাকিয়ে দেখা, যে কতটা সূর্য উঠলো। তারপর একটু ন্যাকামো মায়ের সাথে আর উঠে জানলার ধারে বসে একবার বাইরের চারিদিকটা এক ঝলকে দেখা। তারপর ধরো দাঁত ব্রাশ করতে গেলে, তখন মাথার মধ্যে কতরকমের হিজিবিজি চিন্তা।
আর এখন? এখন সেই জানলা নেই, থাকলেও এসি নামক বস্তুটি খুলতে দেয় না। রোদগুলো মনখারাপ করে ফিরে যায়, ঠান্ডা বাতাস তো আড়ি করে দিয়েছে। শুধু জানলায় এখনো উঁকি মারে, সেই পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো…
একটা দুপুরে—
আর যাই হোক একটা দুপুর কিন্তু সবচেয়ে আলাদা হয় আর তুমি যদি হও বাঙালী, তাহলে তো ভাতঘুম তোমার নষ্ট্যালজিক ব্যাপার। এবার ক্যামেরাটাকে ছোটবেলার জানলার ধারে নিয়ে যাও, দেখবে দুপুরবেলায় মা ঘুমোচ্ছে কিন্তু তোমার চোখে ঘুম নেই। খালি মনের মধ্যে একটা উসখুস ভাব। বারবার জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাইরে কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা দেখার ইচ্ছে, সে গ্রীষ্মকালে আম, কাঁঠালের গাছগুলো হোক বা বর্ষায় খালি ভিজতে চাওয়ার ইচ্ছে। আবার রোববার করে রেডিওটাকে জানলার কাছে বসিয়ে, আকাশবাণীতে ‘শিশুমহল’ শোনার মজাই আলাদা। এখনও সেই ফেলে আসা দুপুরগুলো জানলা গলে চলে আসে কিন্তু আমরা তাদের ধরে রাখতে পারি কই?…
একটা বিকেলে—
অাপনারা লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, দেখবেন, বাংলা সাহিত্যে একটা common line আছে, “পড়ন্ত বিকেলের রোদ যখন জানলা দিয়ে …”। তো যদি আপনি ছোটোবেলার কোনো এক গ্রীষ্মের বিকালে ফিরে যান, দেখবেন আপনাকে খেলতে আসার জন্য আপনার বন্ধুরা জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে অনবরত আপনার নাম ধরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। আবার যদি একটা বসন্তের বিকালের কথা ভাবেন, তাহলে একটা হালকা ঠান্ডা বাতাস আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে আর ওই বাতাসে এমন একটা জাদু বলুন বা ভালো লাগা, আপনি ঘুম থেকে উঠে জানলার পাশে বসতে বাধ্য। তবে হ্যাঁ শীতের বিকেলটা বড্ড ছোট হয়, আর যেহেতু শীতকাল তাই জানলাটা বন্ধ…
একটা রাতে—
আমি জানি না আপনারা কতজন ছোটবেলাটা without electricity মানে হ্যারিকেন, লম্ফের আলোয় কাটিয়েছেন? আমি নিজে সুন্দরবন অঞ্চলের, তো আমি ক্লাস ৬ পর্যন্ত হ্যারিকেনের আলোয় কাটিয়েছি। মানছি একটু কষ্ট হয় গরমে। সে যাই হোক, তো যদি আপনি আপনার ছোটবেলার একটা রাতে ফিরে যান তাহলে সেইসময় আপনি একটা জানলার বসে আছেন, সামনে বইটা খোলা, কিন্তু পড়াতে মন নেই। আপনার চোখটা তখন জানলা দিয়ে বাইরের জোনাকিগুলোর আলো নিয়ে পাগলামি করাটা অবাক হয়ে দেখছে। আবার মাঝে মাঝে হঠাৎ মনে হওয়া জানলার পাশ দিয়ে কে যেন হেঁটে গেল। আবার কোনো সময় জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আকাশের তারা গোনা। মানে নেই কাজ তো, জানলায় বসে থাক…
তো এতটুকুই, এর চেয়ে বেশি আপাতত মনে পড়ছে না। আমি তো এখনও জানলার ধারে বসে ফালতু সময় কাটাই, সেখানে সকাল হয়, দুপুর হয়, পাখিগুলো ঘোরাঘুরি করে, বিকেল গড়িয়ে রাত হয় কিন্তু জোনাকিগুলো—
“আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়,
একটু বর্ষা একটু গ্রীষ্ম, একটুখানি শীত,
সেই একটুখানি চৌকো ছবি আঁকড়ে ধরে রাখা,
আমার জানলা দিয়ে আমার পৃথিবী—”
~ অঞ্জন দত্ত