নচিকেতা,
নামটা কানে এলেই অনায়াসে বারো-পনেরো বছর আগের স্মৃতিগুলো টাটকা হয়ে ওঠে, তাই না?
জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই খেয়াল করতাম, ঘরের বাইরের বারান্দাটায় সেট করা একটা ভি.সি.আর. থেকে বেজে চলেছে~
“যখন সময় থমকে দাঁড়ায়…”
যদিও সময় থমকে থাকতো না মোটেও, মা রান্না করছে, বাবা অফিস যাওয়ার জন্য তড়িঘড়ি ভাত চিবোচ্ছে, বাড়ির সবাই নানা কাজে ব্যস্ত। তবুও চলতে চলতে গানটা কোথাও আটকে গেলে সবার নজর গিয়ে পড়তো ওই ভি.সি.আর.-টার উপর, আস্তে করে একটু ধুম করে বারি দিতেই ভি.সি.আর. ফুঁড়ে আবার বেড়িয়ে আসতো নচিকেতা,
“এই, তুমি কি আমায় ভালোবাসো?”
বাড়িতে ভি.সি.ডি. আসার পর নচিকেতা এল গোল চাকতি সেজে। একটা ক্যাসেটে প্রায় একশোটা গান। তখন আমি ক্লাস টু কি থ্রি-তে, গানের লিরিক্সগুলোর মানে বের করার মতো বুদ্ধি আমার তখনও হয়নি, তবুও কি সহজ ভাবে চিৎকার করে গেয়ে যেতাম~
“সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা…”।
ইস্কুলে একবার খেলার ছলেই নীলাঞ্জনার বদলে এক বান্ধবীর নামটা বসিয়ে গানটা করেছিলাম, বাকিটা আর বলতে চাই না।
সেদিন বাড়ি এসে সন্ধ্যেবেলায় শুনেছিলাম~
“আমি ভবঘুরেই হব, এটাই আমার অ্যাম্বিশন”।
কি জানি, কি বুঝতাম নচিকেতাকে,
‘বক্স অফিস’, ‘মাথা দেব না’ গানগুলো শুনে যেমন হাসিতে ফেটে পড়তাম,
তেমনই ‘অনির্বাণ’, ‘বৃদ্ধাশ্রম’ শুনে দৌড়ে যেতাম ঠাকুর ঘরে, লুকিয়ে কাঁদতাম বেশ কিছুক্ষণ।
মা-বাবার মধ্যে কথা কাটাকাটি হলে—
‘একদিন ঝড় থেমে যাবে…’ গানটা চালিয়ে দিতাম ফুল ভলিউমে, পৃথিবীর খবর জানি না, তবে বাড়িটা শান্ত হয়ে যেত সেদিনই।
নচিকেতা, আমার খুশি হওয়ার কারণ, ওই ছোট্ট বয়সেও লুকিয়ে কাঁদার কারন। আমার ছোটবেলাতে নচিকেতা, নাকি নচিকেতাতে আমার ছোটবেলা? ব্যাপারটা গোলমেলে। তবে নচিকেতা না থাকলে হয়তো আমার ছোটবেলাটা ওভাবে মনে গেঁথে যেতে পারতো না। আজও যখন ‘এক বোকা বুড়োর গল্প’ শুনি, আজও যখন ‘উল্টো রাজার দেশে’ যাই, ছোটবেলাটাকে যেন খুব কাছে দেখতে পাই, খুব খুব কাছে।
এরপরও তো রূপম এল, অনুপম এল… মনের সেই জায়গাটা নচিকেতা আর কারোর হতে দিল কই?
এই কয়েকটা লাইনে যেমন~ নচিকেতা কে? তা বোঝানো সম্ভব নয়, তেমনই, আমার কাছে নচিকেতা কি? সেটাও বোঝানো অসম্ভব। আবেগ যেখানে কড়া নাড়ে, সেখানে হয়তো কলম থমকে যায় বারবার, জড়তা এসে যায় কথা বলার মধ্যে।
তবে গানের সাথেই ছন্দ মিলিয়ে তার সেই হাসিটা যেন আমাকে আজও স্পস্টভাবে বলতে বাধ্য করে~
হ্যাঁ, আমি নচিকেতাকে ভালোবাসি।