ইন্টারর্ভিউ

কদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে এদিকে | আর বৃষ্টি পরলে কলকাতার রাস্তার যে কি অবস্থা হয় তা বলাই বাহুল্য | সুজনের আজ এক বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ইন্টারর্ভিউ | গত কালই সে মেল পায় কোম্পানির তরফ থেকে | সকাল দশটার মধ্যে রাজারহাট পৌছাতে হবে তাকে | সকাল থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি পরেই চলেছে, তাই সে কোন চান্স নেয়নি, সকাল ৮ টার মধ্যে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে গেছিল | ৮:৩০ টার দিকে বাস নিয়ে সে ৯:১৫ র মধ্যেই পৌঁছে গেল গন্তব্যে |রাস্তার ওপরেই অফিস, তাই খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি তার | ধীর পায়ে অফিসের মোটা কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকল সে ভিতরে | সঙ্গে সঙ্গে এক মুশকো দারোয়ান ছুটে এল,

– আরে , ভাই কাহা যানা হে ?

– না, মানে… নৌকরি..

– আরে ভাইয়া কা বোল রাহে হো? কাহা যানা হে?

– আমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্যে ডাকা হয়েছে, তাই…

– ও, আচ্ছা তো পেহলেই বোল সাকতে থে | যাইয়ে উস খাতে পে নাম লিখকর ব্যাইঠিয়ে…

সুজন তাই করল, নাম সই করে পাশের সোফায় বসল সে , পোর্টফলিয়ো ব্যাগটা কোলের ওপর রেখে জড়সড় হয়ে বসল | অফিসটা বৃহৎ, তিনদিকে কাচের দেওয়াল, মাটিতে নরম কার্পেট বিছানো, এক লম্বা কাচের ডেস্কের ওপারে সুন্দরী এক মহিলা বসে কম্পিউটারে কিছু করছে | সুজন সোফায় বসে চারিদিকটা দেখছিল, নিজেকে বড্ড আউট ওফ প্লেস মনে হচ্ছিল তার | মাঝে মাঝে যে সব লোকজন দেখা যাচ্ছে তারা ওপারের দরজা ঠেলে বেড়িয়ে ওই মহিলার সাথে অল্প কথা বলে ফেরত যাচ্ছে আবার নিজের কাজে, তাদের সবারই গায়ে কেতাদুরস্ত পোশাক | এদিকে সুজন গরিবের ছেলে, গায়ে বহু পুরনো তার বাবার শার্ট , ফর্মাল প্যান্টাও দু বছর আগে তার মামার দেওয়া, একদমই দামি নয় সেগুলো আর এই অফিসে….

তবে সে জানে যে তার এই অবস্থার জন্যে একাংশে সেই দায়ী | কলেজ শেষ করে তার মাথায় ভুত চাপল অভিনয় করবে, ওই দিকেই কারিয়ার বানাবে | যেমন ভাবা তেমন কাজ, কলেজের ক্যামপাসিং-এ চাকরি পেয়েও ছেড়ে দিল সে , এক অনামী নাটকের দলে চান্সও পেয়ে গেল কোনমতে | ২ বছর ধরে পার্ট টাইম পড়ানো, বাকিটা নাটক আর ছোটখাটো সিনেমার অডিশন এবং বাড়ির সবার গালাগালি খেতে খেতে চলছিল কোনওরকমে, ভেবেছিল একদিন তার ভাগ্যের শিকে ছিঁড়বে | তবে বাধ সাধল মায়ের রিটায়ারমেন্ট ও দিদির বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসতে | তাও সে লড়ে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ যেদিন তার নাটকের দলটা ভেঙে গেল, সে বাড়ির দিকে তাকানোর সুযোগ পেল, সে বুঝল তাদের বাড়িতে খবরের কাগজ আজ ৩ মাস হল বন্ধ, কাজের লোককেও ১ মাস আগে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এরপরেও সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে তার মায়ের পক্ষেও , সে বাস্তবতার মুখোমুখি হল | তার সকল আশা স্বপ্নের নিরসন ঘটল তৎক্ষণাৎ | সে বুঝল চাকরি তার এখুনি দরকার, প্রচণ্ড ভাবে দরকার না হলে আর বেশিদিন সংসার বাঁচানো যাবে না |

তাই আজ সে এই কোম্পানির অফিসে বসে তার ইন্টারর্ভিউ কলের অপেক্ষায় | তার ভাবনায় ছেদ পরল হঠাৎ এক হই হট্টগোলের আওয়াজে | সে দেখল এক দঙ্গল লোক একটি বয়স্ক তবে সুপুরুষকে নিয়ে উল্লাস করছে | তাদের কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল সুপুরুষটির আজ এই অফিসে শেষ দিন | অজান্তেই তার ঠোটে যেন একচিলতে হাসি এসে গেল | কেমন করে সব কিছুই অন্যকিছুর দ্বারা প্রতিস্থাপন হয়ে যায় | আজ এই ভদ্রলোকটির শেষ দিন আর আজকেই তার ইন্টারর্ভিউ, চাকরিটা হয়ে গেলে সে বোঝহয় হবে ওই শূন্যস্থানেরই পরিপূরক | এভাবেই তো জীবন সব কিছুই বদলে যায়, সকল শূন্যস্থান পূর্ণ হয় | সব কিছুরই এক বাধা সময়সীমা থাকে , যতটুকু তার বরাদ্দ তা নিয়েই জায়গা দিতে হয় নবীনকে | যেমন ভাবে মৃত্যুর পরিপূরক জীবন তেমন ভাবেই জাগতিক সব কিছুই বদল হয়ে যায়…

এক মহিলা বেরিয়ে এলেন ওপারের কাঁচের দরজা ঠেলে,

– সুজন রে ?

– ইয়েস ম্যাডাম, হিয়ার…

– প্লিজ ডু কাম উুয়িথ মি, সার ইস ওয়েটিং |

Facebook Comments Box